
ছবি: সংগৃহীত
১. আগামী অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে ইআরএফ মনে করে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আগেই ব্যাংকিংখাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। কারণ এলডিসি গ্রাজুয়েশনের একটি ধাক্কা অর্থনীতিতে পড়বে। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২. আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে ইআরএফ মনে করে। শুধু সংকোচনমুলক মুদ্রানীতি ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছৃতাসাধনের মাধ্যমে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ চেইনে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভাঙ্গা ও সব ধরনের চাঁদাবাজী বন্ধেও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা।
৪. উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার ওপেন মার্কেট সেল বাড়িয়েছে, যা প্রশংসার যোগ্য। এ ধারা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা জরুরী। একইসঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগী ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করছি।
৫. আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এবং ভর্তুকির চাপে সরকারের পরিচালন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, গত কয়েক বছর ধরে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে না। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে ইআরএফ মনে করে।
৬. বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্তরাও এখন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার উপর আস্থা হারিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। এ অবস্থায় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের প্রত্যেকটিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের স্ট্যান্ডার্ডে একটি করে হাসপাতাল স্থাপন করতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ককর প্রত্যাহার করা।
৭. ধারাবাহিকভাবে ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি বাড়ছে, যা বহনের ক্ষমতা দেশের বেশিরভাগ মানুষের নেই। বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার ৭২%। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর দেশের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় কেন এতো বাড়ছে, তা সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার। আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার কমিয়ে আনার সুপারিশ করছি।
৮. সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জনবলকে এখনও ১/২ টাকা কেজি দরে তেল, চিনি, মসুর ডালসহ বিভিন্ন রেশন পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, অতি দরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বিতরণ করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পণ্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে রেশন পণ্যের দাম বাড়ানো যেতে পারে।
৯. পুলিশ, র্যাব, আনসার, কারা পুলিশ, জেলার, বিচারকসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করলেও বেতন-ভাতার বাইরেও তারা ঝূঁকিভাতা পাচ্ছেন, যা সরকারের অন্যান্য সংস্থায় কর্মরতদের সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এ ধরণের ঝূঁকিভাতা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
১০. ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধের কারণে উল্টো লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
১১. অন্তবর্তীকালীন সরকার বিভিন্নখাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোনখাতে কোন ধরণের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতোটা পড়বে- সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
১২. মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগি কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারিখাতে মিডলেবেল ম্যানেজমেন্টের উপযোগি জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।
১৩. সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। আসন সংকটের কারণে এইচএসসি পাস করে অনেকেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। আবার তাদের অনেকের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা ঝরে পড়ছে।
১৪. এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে রেখে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু বেশিদিন রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে না, তাই সম্ভাবনাময় পণ্যগুলোকে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে প্রমোট করে রপ্তানি উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১৫. এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে রেখে বেসরকারিখাতের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রেডিক্টেবল রাজস্ব নীতি ঘোষণা করার পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার উপর জোর দিতে হবে।
১৬. উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসএমইখাতকে সরকারের বিভিন্ন কাগুজে নীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও বাজেটে এখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তাই এসএমইখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করছি।
১৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, শিক্ষা ও চিকিৎসা উপকরনে কর হার ৫.০ শতাংশে সীমিত রাখা।
১৮. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে পৃথক রাজস্ব নীতিপ্রনয়ন। বন্ড সুবিধা যাতে তারা সহজে পান।
১৯. বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ড কে করমুক্ত রাখা।
২১. ভ্যাটের হার ৭.০ করা।
২২. বাজার মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পদ কর আদায়।
২৩.পত্রিকা, টেলিভিশন,অনলাইনসহ মিডিয়ার কর হার কমিয়ে আনা।
২৪. কাস্টমস এর টাইম রিলিজ স্টাডির মত আয়কর ও ভ্যাটেও একই রকম স্টাডি করা৷
২৫. কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি করছাড়ের আদেশ এর সাথে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেয়া।
২৬. এনবিআরের যে কোন পলিসি ডিসিশনের ইমপ্যাক্ট অ্যানলাইসিস হওয়া উচিত, যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে ডিসিশন নেওয়া সম্ভব হবে। ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্কছাড়ের সুফল কাদের পকেটে যায়, তার নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। একটি ইফেক্টিভ ফিসক্যাল পলিসির জন্য এই গবেষণা ও বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন, যে প্রস্তাব অতীতেও ইআরএফ এর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সমন্বয়ে কিংবা ই আর এফের সহায়তায় এই বিষয়ে গবেষণা করা উচিত।
২৭. কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরী শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এরকম অবস্থায় ৫/১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরী শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে।
২৮. এনবিআরে রিটার্ন জমা এবং ঋণ নেওয়ার সময় ব্যাংকের কাছে দেওয়া সম্পদ বিবরণীর তথ্যে বিস্তর ফাঁরাক থাকে। এখন ড্রাইভার, দারোয়ান, অফিস সহায়কসহ বিভিন্নজনের নামে অনেকে ব্যবসা দেখিয়ে বড় অংকের ঋণ বের করে নিচ্ছে। বেনামি এই ঋণ আর আদায় হয় না।এক্ষেত্রে বড় ঋণ অনুমোদনের আগে এনবিআরের নির্দিষ্ট ডাটাবেজ থেকে ব্যবসায়ীক তথ্য নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে ঋণ জালিয়াতি কমবে। আবার রাজস্ব আদায় বাড়বে।
শাহজাহান/শহীদ