
ছবি সংগৃহীত
তৃণমূল খামারিদের টিকিয়ে রাখতে এবং পোল্ট্রি শিল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষায় ৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছে পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, সরকারিভাবে ডিম-মুরগির সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণসহ খামারিদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করা জরুরি।
সোমবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ খাতের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ প্রস্তাব তুলে ধরেন পোল্ট্রি নেতৃবৃন্দ। সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি)।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের ৬ দফা দাবি: স্বল্পসুদে ঋণের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে ডিম-মুরগির সর্বনিম্ন বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। কোল্ডস্টোরে ডিম সংরক্ষণের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। অফ-সিজনে তৃণমূল খামারিদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। ফিডের দাম কমাতে AIT, TDS, VDS শূন্য করতে হবে। ডিম-মুরগির উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন বিষয়ে কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে হবে।
ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিম ১০ টাকা থেকে সাড়ে ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহসহ পাশের এলাকায় খামার পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হয়েছে গড়ে ৮.৫০ টাকায়; অন্যদিকে টাঙ্গাইল ও নরসিংদিসহ অন্যান্য জেলায় বিক্রি হয়েছে গড়ে প্রায় ৮ টাকায়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিটি ডিমের মূল্য নির্ধারণ করেছে—খামার পর্যায়ে ১০.৫৮ টাকা, পাইকারিতে ১১.০১ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ১১.৮৭ টাকা (সংযুক্তি)। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ১০.১৯ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিম বিক্রি করে খামারির লোকসান হচ্ছে গড়ে প্রায় ১.৬৯ টাকা থেকে ২.১৯ টাকা। ডিমের দৈনিক উৎপাদন সাড়ে ৪ কোটি পিস ধরলে, বিগত ২১ দিনে খামারির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৯ থেকে ২০৬ কোটি টাকা। লোকসান সামাল দিতে না পেরে অনেক খামারি মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন—যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, কারণ রমজান শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত খুললে চাহিদা বাড়বে এবং তখন সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হলে দাম বাড়বে।
মসিউর রহমান বলেন, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিমের দাম কম। পাশের দেশে ডিমের দাম কম বলা হলেও প্রকৃত বিচারে তা কম নয়, কারণ তাঁদের ডিমের দাম ১০% কম হলে ওজনও ১৩% কম। তাছাড়া তাঁরা যে মানের ফিড খাইয়ে ডিম উৎপাদন করে, সে তুলনায় বাংলাদেশের ফিডের মান অনেক ভালো।
ওয়াপসা-বিবি’র সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার প্রামাণিক বলেন, পাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত ডিম অনেক নিরাপদ, কারণ তাঁদের ফিডে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার ও মিট অ্যান্ড বোনমিল ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে এগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব)-এর সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেশী দেশে খামার থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে দামের ব্যবধান থাকে মাত্র ১ টাকা; সেখানে আমাদের দেশে ৩ থেকে ৪ টাকা। তাই ডিমের দাম কমাতে হলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমাতে হবে।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)-এর সাধারণ সম্পাদক শাহ্ ফাহাদ হাবীব বলেন, চলতি মাসে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দামেও পতন হয়েছে। সারাবছর জুড়ে ভারসাম্যপূর্ণ বাজার ধরে রাখা সম্ভব হলে খামারি ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন।
এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আহকাব)-এর সাধারণ সম্পাদক আফতাব আলম বলেন, ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এসেছে যতসামান্যই। এখন তো ডিমের চাহিদা কম, তাহলে সরকারের উচিত হবে ডিম রপ্তানি করে খামারিদের লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করা।
গাজীপুর মাওনার খামারি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ৭.৩০ টাকাতেও ডিম বিক্রি করতে হয়েছে; ডিম সংরক্ষণ করতে পারিনি, কারণ সংরক্ষণ করলে অভিযান চালানো হয়, জরিমানা আদায় করা হয়। সরকার খামার পর্যায়ে ডিমের দাম নির্ধারণ করেছে, কিন্তু আমরা সে দামে বিক্রি করতে পারছি না।
তিনি বলেন, ডিমের দাম বাড়লে আমাদের সাথে এমন আচরণ করা হয় যেন আমরা কোনো দাগী আসামি! যৌক্তিক লাভ করার অধিকার আমাদেরও আছে। তোফাজ্জল বলেন, আমরা নিজের জন্য উৎপাদন করি না, বরং ভোক্তার জন্যই উৎপাদন করি।
ডায়মন্ড এগস-এর সিইও কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান মেজবাহ বলেন, বছরের ৩-৪ মাস লোকসানে ডিম বিক্রি করতে হয়। শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। তিনি বলেন, খামারিদের ভয় না দেখিয়ে বরং প্রশংসা করা উচিত, তাহলেই ডিমের উৎপাদন বাড়বে।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তারা বলেন, আগামী কয়েক বছরে ডিমের চাহিদা আরও বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, মাথাপিছু ডিমের চাহিদা ১৩৫ থেকে বেড়ে ৩০০ হবে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন আড়াই গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
আশিক