
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আফম খালিদ হোসেন
ইসলাম ধর্মের ৫টি স্তম্ভ। যাকাতের মধ্যে অন্যতম। অবাক করার বিষয় হলো- প্রতিটি স্তম্ভ ব্যক্তিগতভাবে পালন করা হয়। শুধুমাত্র যাকাতকেই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের অংশ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে মুসলিম সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে যাকাত একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশে যেসব সংগঠন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাতের কার্যক্রমে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তাদের মধ্যে অন্যতম ছওয়াব ফাউন্ডেশন।
১৯৯৫ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিষ্ঠা করা ছওয়াব এখন দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ছওয়াব এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে আছেন এস এম রাশেদুজ্জামান। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক মুসলিম এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডাইরেক্টর ছিলেন। যাকাত আদায়ে সংগঠনটির কার্যক্রম ও এর ফলাফল নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জনকণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক জাহিদুল ইসলাম।
জনকণ্ঠ ॥ যাকাত কি, অর্থনীতিতে এর অবস্থান কেমন হওয়া উচিত।
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ অর্থনীতি মানুষের জীবনের একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে। যাকাতের পারিভাষিক অর্থ হলো- বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, পরিশুদ্ধ করা ইত্যাদি। যাকাত মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে পরিশুদ্ধ করে। অর্থাৎ ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য। একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।
কুরআনে বলা হয়েছে, ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার রয়েছে। ইসলামে কোথাও বলা হয়নি যে, তোমরা দান-অনুগ্রহ গ্রহণ করো। বরং বলা হয়েছে, যাকাত, সদাকা বা ডোনেশন অন্যকে দাও। এজন্য যাকাত বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। যাকাত ধনীদের থেকে সংগ্রহ করে গরিবের কাছে পরিকল্পিতভাবে পৌঁছে দেওয়া রাষ্ট্রের কাজ।
জনকণ্ঠ ॥ আপনি বললেন, যাকাত হলো ধনীদের সম্পদে গরিবের অংশ। আমার শ্রম ও মেধায় অর্জিত সম্পদে কেন অন্যের অংশ থাকবে?
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ আল্লাহ বিধান করে দিয়েছেন, আমি যত কষ্ট পরিশ্রমই করি না কেন, আমার সম্পদের আড়াই শতাংশ গরিবের অধিকার, সেহেতু এটা পালন করতে হবে। এটা সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। আরেকভাবে এতে কিন্তু ধনীদেরই উপকার নিহিত রয়েছে। কেননা এই গরিব মানুষদের যখন ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে তারা হয়তো আপনার শিল্প কারখানার প্রোডাক্ট কিনবে, কাপড় কিনবে।
এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আপনার টাকাই বর্ধিত আকারে আপনার কাছে ফেরত আসবে। সমাজে সাধারণত দরিদ্র্যের সংখ্যাই বেশি। তারা যদি কোনো কারণে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বা ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে আপনি বেশি দিন ধনী থাকতে পারবেন না।
জনকণ্ঠ ॥ আমাদের এসডিজির কিছু গোল আছে। এসব অর্জনে যাকাত কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে?
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ আমাদের এসডিজির অন্যতম উদ্দেশ্য দারিদ্র বিমোচন। দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত অন্যতম মাধ্যম বা উপায়। এজন্য এসডিজির গোলগুলোকে আগে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের এসডিজিতে ১৭টি গোল আছে। আমাদের কাজের মাধ্যমে প্রায় ১৭টি গোলই আমার অ্যাড্রেস বা চিহ্নিত করে থাকি। যেমন- জলবায়ুর উপর আমরা কাজ করে থাকি, নারীর ক্ষমতায়নে আমরা ট্রেনিং-মোটিভেশনের মাধ্যমে কাজ করি, তাদেরকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে। এটা ক্ষুদ্র ঋণ না, মূলত তাদের সঙ্গে আমরা একটি ব্যবসা করি।
জনকণ্ঠ ॥ প্রতিবছর যাকাত ফান্ডে এবং অনুদানের টাকা আসে। সে ক্ষেত্রে এক তহবিলের টাকা আরেক তহবিলে ব্যয় করা হয় কিনা, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করেন?
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ যাকাত ফান্ডের জন্য আমাদের আলাদা অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টে অন্য কোনো টাকা ঢুকানো হয় না এবং অন্য কোনো খাতে ওই টাকা ব্যয়ও করা হয় না। এটা শুধু যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যই বরাদ্দ। তবে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের যে ৮টি খাত রয়েছে সবগুলোতেই যে একত্রে খরচ করি তা নয়, বিশেষ করে অর্থনৈতিক দারিদ্র্যতা দূর করতে আমরা ব্যয় করে থাকি। আমরা প্রতি বছরই অডিট করে থাকি, এজন্য আলাদা কমিটি করা আছে, শরিয়াহ বোর্ড আছে।
আমরা এই তহবিলের টাকা কোথায় থেকে আসলো, কোথায় ব্যয় হলো সে সব হিসাবের জন্য মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে থাকি। বিভিন্ন সার্ভে করে দেখা গেছে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি তোলা সম্ভব। এই টাকা যদি পরিকল্পিতভাবে তোলা এবং খরচ করা হয়, তাহলে দারিদ্র্য বিমোচনে সময় লাগবে মাত্র ৫-১০ বছর। কিন্তু গত ৫৩ বছর ধরে আমরা এর অভাব বোধ করছি।
জনকণ্ঠ ॥ সরকার যাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন করেছে ২০২৩ সালে। আবার যাকাত ফাউন্ডেশন ও যাকাত বোর্ডও আছে। সরকারের যাকাতের উপরে এতকিছু থাকতেও কেন যাকাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার হচ্ছে না।
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ যে ব্যক্তি সঠিক অর্থে ইসলামকে মানে না, সে যাকাতের ব্যবস্থাপনাকেও মানে না, মানবে না। বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ, এখানে একটি যাকাত বোর্ড আছে, কিন্তু দুর্বল-নামকাওয়াস্তে। যাদের কোনো শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা নেই, যাকাত তোলে খুব কম পরিমাণে। অর্থাৎ এই সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কোনো পরিকল্পনাই সরকারের নেই। অর্থাৎ যাকাত বোর্ডের যে ম্যানেজমেন্ট সেখানেই দুর্বলতা রয়েছে। অথচ এই সুন্দর সিস্টেমের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন বহুলাংশে দূর করা সম্ভব।
জনকণ্ঠ ॥ মানুষের মাঝে কীভাবে যাকাতের বিষয়ে সচেনতা তৈরি করা যায়, যেন তারা সঠিক পদ্ধতিতে যাকাত দিতে পারে?
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ আমরা এজন্য প্রচারণা চালাচ্ছি। লিফলেট বিতরণ করছি, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে যাকাতের তাৎপর্য নিয়ে চিঠি লিখছি। আমরা ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো মেগাসিটিগুলোতে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করছি। এ ছাড়া জেলা-উপজেলায় যেখানে আমাদের মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট কার্যক্রম রয়েছে সেখানে অ্যাওয়ারনেস বিল্ড করা হচ্ছে। এ ছাড়া যেখানে প্রোগ্রাম হয়, যেমন এই রমজান কর্মসূচিতে আমরা ১৫ থেকে ২০টি জেলায় হয়েছে। সেখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক হয়, সেখানে আমরা এই আলোচনা রাখি।
জনকণ্ঠ ॥ ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যাকাতের অর্থে অন্য ধর্মের লোকদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ আছে কিনা?
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ অবশ্যই সুযোগ আছে। যারা দুস্থ কিন্তু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তাদেরকে উপকার করার মাধ্যমে মন জয় করা এবং ইসলামের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার বিষয়ে বলা আছে। তবে ইসলামে যে তাকে আসতেই হবে এর বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ কুরআনে বলা হয়েছে ইসলামে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।
জনকণ্ঠ ॥ ছওয়াব এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
এস এম রাশেদুজ্জামান ॥ ছওয়াব (ঝঅডঅই) বা সোশ্যাল এজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছওয়াব এর ১২টি কর্মসূচি আছে। ছওয়াব ফাউন্ডেশন নামে আলাদাভাবে করেছি, যেটার মাধ্যমে মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম পরিচালনা করি এবং যাকাতকে আমরা এই ছওয়াব ফাউন্ডেশনের মধ্যে নিয়ে এসেছি। স্থানীয় রিসোর্সকে কালেক্ট করার জন্য।
মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট হলো ইনকাম জেনারেট করার জন্য। কিন্তু যাকাত দিয়ে দিতে হয়। ছওয়াব ফাউন্ডেশনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট, যাকাত প্রোমোশন, এতিমদের শিক্ষা কার্যক্রম, পথশিশুদের শিক্ষা প্রদান, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসার মাধ্যমে যেন তাদের মূলধারায় নিয়ে আসা যায়।