ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২৩:২১, ২৩ মার্চ ২০২৫

আল বিদা মাহে রমজান

আজ মাহে রমজানের ২৩তম দিবস

আজ মাহে রমজানের ২৩তম দিবস। একে একে শেষ হতে চলেছে ইবাদত বন্দেগি ও ধর্মীয় আবেগ সঞ্চারের শ্রেষ্ঠ মাসটি। এ মাস যেমন কৃচ্ছ্র সাধন ও ত্যাগ তিতিক্ষা শিক্ষার, তেমনি অনেক মুসলিম মনীষী রয়েছেন, যারা ইসলামের এ বিকাশের ক্ষেত্রে বিশাল ত্যাগ তিতিক্ষা ও অবদান রেখে গেছেন। এ মাহে রমজানে তাদের জীবনকথা সিয়াম সাধকদের মনে আবে হায়াৎ সঞ্চার করে। তেমনি এক দরদী মনীষী হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।

৬৩৪ সালে ঠিক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর মতো ৬৩ বছর বয়সে উম্মতের সব চাইতে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হজরত আবু বকর (রাদি.) ওফাৎপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মহানবীর (স.) সুখ-দুঃখের এ মহান সাথি সকল যুগের মুসলমানদের জন্য আদর্শ হয়ে রয়েছেন। হজরত (স.) স্বয়ং তার সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন- ‘বন্ধুত্ব ও অর্থ সাহায্যের দিক দিয়ে আমি আবু বকরের নিকট হতে সর্বাপেক্ষা অধিক ইহসান প্রাপ্ত হয়েছি।’-(বুখারী)।
এ মহান সাহাবীর তিরোধান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মাহমুদ আল আক্কাদ বলেন- পৃথিবী হতে এমন একটি জীবনের অবসান হলো, যা শিষ্টাচার ও ভদ্রতার ইতিহাসে অতুলনীয় ছিল।’-(ই. বিশ্ব কোষ ২/১২৫)। আমাদের উচিত প্রিয় নবীর (স.) এ প্রিয় সাহাবী সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়ে আমাদের ঈমান ও ইশ্ককে মজবুত করা, জ্ঞান ও উপলব্ধির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা।

তার পারিবারিক নাম আবদুল্লাহ, তবে আবু বকর উপনামেই তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। পিতা আবু কুহাফা ওসমান। পিতা-মাতা উভয়ে ছিলেন মহানবীর (স.) সাহাবীর অন্তর্ভুক্ত। আবু বকর (রাদি.)-কে ‘আতিক’ নামেও স্মরণ করা হতো। ‘আতিক’ অর্থ সৌন্দর্যের অধিকারী, তিনি প্রথম জীবন হতেই রুচিশীল এবং সত্যনিষ্ঠ ছিলেন- এজন্য তাকে আতিক বলা হতো (আর ইসাবা)। স্বয়ং হজরত (স.) এ নামের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলেন- ‘আবু বকর জাহান্নাম হতে চিরমুক্ত।’-(তিরমিজি ২/২১৪)। পরবর্তীতে মহানবী তাকে ‘সিদ্দিক’ উপাধি দান করেন। এর অর্থ সত্যবাদী এবং সত্যের স্বীকৃতি দানকারী।’ 
সম্পর্কের দিক দিয়ে আবু বকর (রাদি.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চাচাত ভাই। (ই. বিশ্বকোষ ২/১২১)। তিনি রাসুল (স.)-এর আড়াই বছরের ছোট। জন্ম হিজরতের ৫০ বছর ৬ মাস পূর্বে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে আবু বকর প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই রাসুলের (স.) সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। স্বভাব চরিত্রের সাদৃশ্যের ফলে তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, হজরত মুহাম্মদ (স.) সকালে এবং বিকালে আবু বকরের গৃহে অবশ্যই গমন করতেন।

ইসলাম গ্রহণকালে তিনি চল্লিশ হাজার দিরহাম পুঁজিসম্পন্ন একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি জাহেলী যুগেও মদ্যপান পরিহার করে চলতেন। ইসলাম গ্রহণের পর ধর্মের জন্য তিনি তার ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং জনবল সমস্তই উৎসর্গ করেন। তিনি কাফির শ্রেণির হাতে বহুবার নির্যাতনেরও শিকার হন অন্যান্য মজলুম সাহাবার মতো।-(বুখারী)। মক্কাবাসী কুফফারদের হাতে মজলুম মুসলমানগণ যখন ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তখন হযরত (স.) তাদেরকে হিজরত বা দেশত্যাগের অনুমতি দেন।

এ সূত্র ধরে আবু বকর যখন দেশ ত্যাগের অনুমতি প্রার্থনা করেন, তখন প্রিয় নবী বলেন- ‘তুমি আপাতত ধৈর্য ধারণ করো, কেননা আশা করি আমিও হিজরতের অনুমতি লাভ করবো।’ অতঃপর রাসুলে কারীম (স.) হিজরতের আদেশ লাভকালে আবু বকরকে তাঁর সফর সঙ্গী মনোনীত করেন। পথিমধ্যে সাওর গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। এটিই ছিল আবু বকরের সবচেয়ে গৌরবের দিন এবং তামাম উম্মতের জন্য নবী প্রেমের দৃষ্টান্ত অনুভবের বিরল মুহূর্ত।

সেদিন সমস্ত কাফিরগণ এ দুজনকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছিল। কিন্তু তারা এক আল্লাহর ওপর ভরসা করে আশ্রয় নেন একটি গুহায়। পরিশ্রান্ত নবীজী কোনো এক ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আবু বকরকে ঠেক দিয়ে। তখন এক বিষাক্ত সাপ দংশন করলেও তিনি মহানবীর ঘুম ভাঙাননি। তার কাছে বিষের যন্ত্রণা ও জীবন থেকে মহানবীর বিশ্রাম অগ্রাধিকার পেয়েছিল। আল্লাহতায়ালা এ গুহা জীবনকে কেন্দ্র করে আল কুরআনে ‘দুই জনের মধ্যে দ্বিতীয়’ (৯ঃ৪০) আখ্যায় হজরত আবু বকরের নাম অমর করে আত্মত্যাগী এই মহান ভক্তকে পুরস্কৃত করেন।

উম্মতের মধ্যে আবু বকরের বিশেষত্ব আরও এই, তার কন্যা আয়েশা (রাদি.) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের পতœী। তিনি সকল যুদ্ধে মহানবীর (স.) সঙ্গে ছিলেন এবং পাশেই অবস্থান করতেন, নাজুক এবং বিপজ্জনক মুহূর্তেও তিনি অটল থাকতেন, কোনো অবস্থাতেই সাহস হারাতেন না। হজরতের (স.) ওফাতের পর তিনি সর্বসম্মতিক্রমে খলিফাতুর রাসুল বা রাসুলের (স.) খলিফা উপাধি ধারণ করেন এবং ২ বছর ৩ মাস ১১ দিন খিলাফত পরিচালনা করেন। 
সিয়াম সাধনা ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের মাঝে এ ধরনের চরিত্র ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করুন।

×