ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

সাংবাদিকদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে স্বাক্ষর হবে সমঝোতা স্মারক

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৩ মার্চ ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে স্বাক্ষর হবে সমঝোতা স্মারক

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন

আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এই চীন সফরের সময় কোনো চুক্তি সই হবে না। তবে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, এ সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহযোগিতা, পানি ব্যবস্থাপনা ও তিস্তা ইস্যুসহ চট্টগ্রামে চীনের বাণিজ্যিক কারখানা স্থাপন এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও আলোচনায় থাকতে পারে ভারত- যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ও। দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
আঞ্চলিক পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে এই সফর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার, চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। 
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (জিডিআই) বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জিডিআইতে যুক্ত হতে আমাদের আপত্তি নেই, তবে আমরা এর অংশ হবো কি না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য বেইজিংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে। আমরা চীনের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই এবং সেখানে আমাদের পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।’ 
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর মাইলফলক বলেও মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রাষ্ট্রদূত। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সফর নিয়ে চীন খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। 
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাসহ এই সফর খুবই ফলদায়ক হবে। বাংলাদেশ ও চীনের লাভ কিসে হবে, সেটাই হবে সফরের আলোচ্য বিষয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। সেখানে ভারত- যুক্তরাষ্ট্র বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা গুরুত্ব পাচ্ছে ॥ তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রধান একটি আলোচ্য বিষয় হলো চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। আমরা আশা করছি, চীনা কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা এখানে স্থানান্তর করবে এবং বাংলাদেশের অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশের সুবিধা নেবে। এই সফর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এই সফরে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে, যা বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির পথ প্রশস্ত করবে।
স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা ॥ স্বাস্থ্যসেবা খাতেও সহযোগিতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়, বিশেষ করে বাংলাদেশী রোগীরা ভারতের ভিসা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে চিকিৎসা নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশী রোগীদের প্রথম দল ইতোমধ্যে চীনে চিকিৎসার জন্য গেছে। আমরা চাই চীন ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনে বিনিয়োগ করুক।
বাংলাদেশ চীনের কাছে অনুরোধ করেছে কুনমিংয়ে চারটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করতে, যেখানে বাংলাদেশী রোগীদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকবে। এই প্রথম দলটির অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের চিকিৎসা সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পানি ব্যবস্থাপনা ও তিস্তা ইস্যু ॥ পানি ব্যবস্থাপনাও আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়, যেখানে বাংলাদেশ নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে তিস্তা নদী ইস্যুতে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এগিয়ে নিতে চাই।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ॥ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। বৈশ্বিক জোটের রদবদলের মধ্যে বাংলাদেশ যখন তার পথ নির্ধারণ করতে চাচ্ছে, তখন ড. ইউনূস চীন সফরে যাচ্ছেন। তার এই সফর কৌশলগত বিবেচনার সঙ্গে অর্থনৈতিক আবশ্যিকতার ভারসাম্য বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার স্পষ্ট অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সফর প্রতীকী তাৎপর্য বহন করছে এবং ভবিষ্যতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করবে। প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের প্রতীকী তাৎপর্যের ওপর জোর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, এই সফর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এই সফরে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে, যা বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির পথ প্রশস্ত করবে।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। তবে তিস্তার মতো বড় প্রকল্পগুলোর জন্য সম্ভবত নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, চীনের কাছ থেকে বিনিয়োগ বা বড় চুক্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো বাধা হবে না। চীন জানে, এই অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। তিস্তা ইস্যুতে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার নিজস্ব স্বার্থে বেইজিংয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করা উচিত।
তিনি আগামী এপ্রিল মাসে ঢাকায় আয়োজিত বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখছেন। জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোতে পারস্পরিক স্বার্থ তুলে ধরে তিনি বলেন, উন্নত মানের চিকিৎসা সুবিধা প্রতিষ্ঠায় চীনের আগ্রহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। চীনের বৃহত্তম সৌর প্যানেল কোম্পানি শিগগিরই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে।
সম্ভাব্য ভ্রমণসূচি ॥ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে ২৬ মার্চ চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। ২৭ মার্চ তিনি সম্মেলনের উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন এবং চীনের নির্বাহী ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েশিয়াং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা বেইজিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপলে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। তার হুয়াওয়ের একটি উচ্চ প্রযুক্তির উদ্যোগ পরিদর্শন ও চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২৯ মার্চ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি সেখানে বক্তব্য দেবেন। এরপর ওই দিনই প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে।

×