ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন

‘মাফিয়া চক্রের হাতে সকল দরপত্র আটকে ছিল’

অর্থনৈতিক রিপোর্টার:

প্রকাশিত: ২০:১০, ২৩ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ২০:৫৮, ২৩ মার্চ ২০২৫

‘মাফিয়া চক্রের হাতে সকল দরপত্র আটকে ছিল’

পরিকল্পনা কমিশনের উদ্যোগে সরকারি ক্রয় নীতি সংশোধন-অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন, ২০১৬ সালে যে ক্রয় নীতি তৈরী করা হয়েছিল তাতে একটি মাফিয়া চক্র ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন কিছু শর্ত রেখেছিল যাতে সব সময় একটি গোষ্ঠী বা চক্র দরপত্র অনুমোদন পেয়ে আসছিল। আমরা এটি সংশোধন করে একটি ছক করে দিয়েছি, তাতে কতগুলো সূচক আছে। এর ফলে এখন উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দামের এবং দক্ষতার প্রতিযোগিতা হবে।

রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, এখন সরকারি সকল ক্রয় নীতি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আরো স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতামূলক এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার উপর জোর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। সমস্ত প্রকল্পেই জবাবদিহিতা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্প নতুন হলে মন্ত্রণালয়ে আসে আর পরিকল্পনাতেও আসে সংশোধন করতে হলে। কিন্তু অধিকাংশ (প্রায় এক হাজার) চলমান প্রকল্প, মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আসছে না, পরিকল্পনা পর্যায়েও আসছে না। 

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, দুর্নীতি ধরব নাকি সংস্কার করব। দুর্নীতি ধরতে গেলে আমাদের সারাদিন শুধু এটিই করতে হবে। অন্য নীতিগত সংস্কার তো পারবো না। এটা একটা সিদ্ধান্তের বিষয়।

প্রকল্পগুলোর অনিয়মে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সম্পৃক্ততা রয়েছে এমনটা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে এবং এটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ধরতে পারছিলাম না। যখন আমার মাথায় ঢুকলো তারা কিভাবে এটা করছে, আমি তো এ প্রকল্পে সই করিনি। তখন দেখলাম এটা হলো চলমান প্রকল্প। চলমান প্রকল্প হলে সেটার পিডি থাকে, পিডিরা খুব শক্তিশালী হয়।

তিনি বলেন, প্রকল্পে যে বরাদ্দ, সেটা অটোমেটিক্যালি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেয়ে যান পিডিরা। কাজেই সেখানে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে উপদেষ্টাও সম্পৃক্ত না। আবার পরিকল্পনা কমিশনও এখানে সম্পৃক্ত না। এটা অনুমোদন হয়েছে, অর্থ বরাদ্দ আছে, অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ দিতে বাধ্য। তো চলছেই। এধরনের কাজে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, আমরা কি সংস্কার করব নাকি দুর্নীতি ধরবো।

সংবাদ সম্মেলনে পায়রা সমুদ্র বন্দর নিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, পায়রা বন্দর সমুদ্র বন্দরতো দূরের কথা নৌ-বন্দরও হবে না। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটা বিষফোঁড়া হবে। প্রকল্পটি শর্ত সাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কারণ, এই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। তবে বন্ধ করে দেওয়ার আগে ওইখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা পরিবহনের সুবিধার্থে কিছু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আপতত প্রকল্পটি চালু থাকবে।

উপদেষ্টা বলেন, পায়রা বন্দরের নাব্যতা ঠিক রাখতে বছরে দুই বার ড্রেজিং করতে হবে। প্রতিবছরে জ্রেডিং করে এবং আমদানি করা কয়লা পরিবহন করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কতটুকু সুফল আসবে তা দেখতে হবে। ক্ষতির পরিমাণ যদি বেশি হয় তাহলে এই প্রকল্প রেখে লাভ হবে না।

তিনি বলেন, পরিদর্শন শেষে পায়রা বন্দর প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কোনো এক উপদেষ্টা অপচয় রোধ করতে পায়রা বন্দরের পরিবর্তে বিমানে কয়লা পরিবহনের প্রস্তাবও দিয়েছেন। এসময় পরিকল্পনা উপদেষ্টা নিজেই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি ও তা প্রদর্শন, টেন্ডারে মাফিয়া কালচার বন্ধে শতভাগ অনলাইনকরণ, অনুমোদিত প্রকল্পের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতে করণীয়, প্রকল্পের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা, নদী রক্ষায় বিশেষ প্রকল্প প্রস্তাবনাসহ নানা বিষয় নিয়ে উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন।

এর আগে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সভায় ২১ হাজার ১৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫টি নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এসব প্রকল্পের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৪ হাজার ১৯৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ৬ হাজার ৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৪০৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

সভার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, খাদ্য এবং ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অনুমোদিত প্রকল্পসমূহ হলো: নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প; বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্প- চট্টগ্রাম মহানগরীর কালুরঘাট এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প, স্ট্রেনথ ইনস্টিটিউশন ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপ্ট ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ইন ঢাকা প্রকল্প, এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) প্রকল্প; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পঞ্চবটি হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প (১ম সংশোধন) প্রকল্প।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন প্রকল্প; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) প্রকল্প; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি প্রকল্প, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সারাদেশে অবস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্য গুদাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর মেরামত ও সংস্কার প্রকল্প; ভূমি মন্ত্রণালয়ের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থাপিত রেকর্ড রুমসমূহ সংস্কার ও মেরামত প্রকল্প; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রভেন বুল তৈরি প্রকল্প এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়েশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভৌত সুরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প।

এছাড়া কুষ্টিয়া জেলায় নতুন সার্কিট হাউজ নির্মাণ (১ম সংশোধিত) ৪র্থ বার বৃদ্ধি, চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড (পতেঙ্গা হতে সাগরিকা) (৪র্থ সংশোধিত) ৪র্থ বার বৃদ্ধি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর অধীনে সুপার স্পেশিয়ালাইজড হাসপাতাল স্থাপন (২য় সংশোধিত) চতুর্থ বার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব সভায় পাস করা হয়।

সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা অনুমোদিত ১৩টি প্রকল্প সর্ম্পকে একনেক সদস্যদের অবহিত করা হয়। সেগুলো হলো- বানৌজা শের-ই-বাংলা পটুয়াখালী স্থাপন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত নির্মাণ ও উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ইসিবি চত্বর হতে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশু কার্ডিওলজি ও শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিদ্যমান গামা সোর্স শক্তিশালীকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ভ্রাম্যমাণ বিজ্ঞান প্রদর্শনী-বিসিএসআইআর (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, সিলেট টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন-(২য় সংশোধিত) প্রকল্প, কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ (কম্পোনেন্ট-সি) (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় লামাবাজার রক্ষাকল্পে মাতামুহুরী নদীতে প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন প্রকল্প, কক্সবাজার জেলায় সবুজ বেষ্টনী সৃজন, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) প্রকল্প চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প (১ম সংশোধিত) প্রকল্প এবং ফিজিবিলিটি স্টাডি অন লাইভস্টক সার্ভিস ট্রান্সফরমেশন (এলএসটি) প্রকল্প।

আফরোজা

আরো পড়ুন  

×