
ছবি: সংগৃহীত
- প্রাক্কলিত ব্যয়ের দ্বিগুনেরও বেশি সংশোধিত ব্যয়।
- ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১১টি সংশোধনের প্রস্তাব।
- সাত প্রকল্পের প্রারম্ভিক ব্যয় ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ২৮ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
- প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি সংশোধনের অন্যতম কারণ।
- মেয়াদ বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে ২০১৫ সালের অনুমোদিত প্রকল্প।
- টাইম শিডিউল মেইনটেইন না করায় বাড়ে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়- রাশেদ আল মামুন, সাবেক সচিব, পরিকল্পনা বিভাগ।
বিগত সরকারের সময়ে নেয়া একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো। এসব প্রকল্প সমাপ্তে যেমনিভাবে মেয়াদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমন বাড়ছে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ। প্রকল্পগুলো অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বৃদ্ধি ও মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পগুলোর এমন সংশোধন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করতে ব্যর্থতা ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রকল্পের টাইম শিডিউল মেইনটেইন না করার বিষয়টিকেই তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
রবিবার অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়ও নতুন প্রকল্পের চেয়ে আগের প্রকল্পগুলো সংশোধন আকারে বেশি উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে বলে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আজকের একনেক বৈঠক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৮ম এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ম সভা। এই সভায় উপস্থাপিত হতে যাওয়া ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১১টিই সংশোধিত। বৈঠকে এমনও প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করা হচ্ছে যেগুলোর কোন কোনটির মেয়াদ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ৭টি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরদিকে ১টি প্রকল্পের ব্যয় হ্রাস ও ৩টির শুধু মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধিত এসব প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল সর্বমোট ১৮ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে যে ৭টি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে সে প্রকল্পগুলোর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। কিন্তু আজকের সভায় ওইসব প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ৭টি সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ১৫ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রাক্কলিত ব্যয়ের দ্বিগুনেরও বেশি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে।
যে ৭টি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো- নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়াধীন পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মান (২য় সংশোধিত), বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ (১ম সংশোধিত), স্থানীয় সরকার বিভাগের সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ (২য় সংশোধিত), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ (২য় সংশোধিত), সেতু বিভাগের পঞ্চবটি হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প (১ম সংশোধন), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) এবং বিদ্যুৎ বিভাগের স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অফ বিপিডিবি (১ম সংশোধিত)।
এর মধ্যে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়াধীন পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মান (২য় সংশোধিত) প্রকল্প ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটি সংশোধিত প্রস্তাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সংশোধনের বিষয়ে প্রকল্প অর্থায়নের উৎস পরিবর্তন, বিভিন্ন অঙ্গে ব্যয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যমান রানওয়ে ও টেক্সিওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পটি প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৪০ কোটি ৫২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সংশোধনের বিষয়ে প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পটির বিষয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুন মাসে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবে ২০২৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রাক্কলিত ব্যয় ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সংশোধনের বিষয়ে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু সমাপ্ত মেয়াদের ৭ বছর পরও প্রকল্পটি অদ্যবধি চলমান। বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৭৯৩ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধনীতে ১ হাজার ৭’শ কোটির প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অঙ্গভিত্তিক ব্যয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সেতু বিভাগের অধিনে নির্মানাধীন নারায়নগঞ্জের পঞ্চবটি হতে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প (১ম সংশোধন) এর বিষয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবে এই মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩১৯ কোটির প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরামর্শক সেবার মেয়াদ বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহন ব্যয়, যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ব্যয় ও প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন (২য় সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবে এই মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রাক্কলিত ব্যয় ৬৭৩ কোটি টাকা থেকে ৮০৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন করে স্থান নির্বাচন, হালনাগাদ ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তাবিত প্রকল্প দলিলে সংযোজন, আসবাবপত্রের মূল্য বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেক করা হয়েছে।
সংশোধিত প্রস্তাবে সর্বশেষ বিদ্যুৎ বিভাগের স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অফ বিপিডিবি (১ম সংশোধিত) প্রকল্পটি সংযোজন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০২২ সালের মার্চ মাসে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, এটিকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রাক্কলিত ব্যয় ৬১৯ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৭৭১ কোটি টাকা করতে প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি সংশোধনের কারন হিসেবে কার্যপরিধি পরিবর্তন, বৈদেশিক ঋণের সুদহার ও ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পরিবর্তন, বিভিন্ন অঙ্গভিত্তিক ব্যয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব রাশেদ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিতে অঙ্গভিত্তিক যে ব্যয়ের কথা বলা হচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। কেননা গত দুই-তিন বছরে কোন জিনিসেরই দাম দ্বিগুনের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়া ডলার রেটের যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে তাও সঠিক নয়, কারণ এই সময়ে ডলার রেটে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বিচ্যুতি হয়েছে। এতে কিভাবে দ্বিগুনেরও বেশি বাড়ার কথা না। এগুলো প্ল্যানিং কমিশনকে দেখতে হবে, একটা একটা করে হিসাব বুঝে নিতে হবে। প্রত্যেকটি প্রকল্পে আগে কি ছিল, বর্তমানে পরিমাণে বেড়েছে কিনা? যদি কাজের পরিমান বেড়ে থাকে তাহলে সেটার একটা ভিত্তি আছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন করতে হবে- পরিমাণ বাড়ালে এখন কেন বাড়াতে হবে। এটা তো আগেই জানার কথা। এটা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য না।
সঠিক সময়ের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্তে জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু আমাদের একটা ট্রেডিশন হয়ে গেছে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে না পারা। এখানে আমাদের দুর্বলতা হলো- প্রকল্প বাস্তবায়নে যে কর্তৃপক্ষ থাকে এবং প্রকল্পের যে পরিচালক থাকে, তারা প্রতিটি প্রকল্পের যে টাইম শিডিউল দেয়া থাকে সেটিকে অনুসরণ করতে পারে না। এখানে আরেকটি বিষয় আছে, ধরুন- এখন মার্চ মাস, আগামী আগস্ট মাসে তারা যে টেন্ডারটি দেবে, সেটির জন্য এখন থেকেই অনেক প্রস্তুতিমূলক কাজ আছে। টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরীসহ বিভিন্ন আনুসঙ্গিক কাজ করা। এগুলো আগে থেকেই মনিটরিং করে না, ফলে টেন্ডার প্রদানকালে ওইসব কাজের জন্য সময় বেড়ে যায়। অর্থাৎ আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকল্পের যারা কর্তৃপক্ষ তারা এক্টিভিটি শিডিউল বা টাইম শিডিউল মেইনটেইন করে কাজ করতে অভ্যস্ত না বা এ ব্যাপারে তাদের দক্ষতা নেই। মূলক এ কারণেই আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে এবং ব্যয়ও বাড়ে।
শহীদ