ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৪ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১

আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন ইস্যু

রাজনীতির মাঠে ফের উত্তাপ

​​​​​​​বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:২৬, ২৩ মার্চ ২০২৫

রাজনীতির মাঠে ফের উত্তাপ

.

গত আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেপুনর্বাসনইস্যুতে ফের উত্তাল হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড়ের মাঝে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া বা না-দেওয়ার ইস্যুটি আবারও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল ব্যাপারে নমনীয় হলেও জামায়াত, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন ইসলামিক দলের পক্ষ থেকে বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করারও দাবি উঠেছে।

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্ট দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। মুহূর্তেই হাসনাতের ফেসবুক পোস্টে দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। আলোচনার জেরে বৃহস্পতিবার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। সেই রাত থেকেই ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক . মুহাম্মদ ইউনূস ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় একটি বৈঠক করেন। ওই প্রতিনিধি দলকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।

প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা হচ্ছে- এমন আলোচনা সামনে আনা হয়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ আগস্ট নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপটার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।

এরপর ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তাতে তিনি লেখেন, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগনামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী তাপসকে (ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস) সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।

গত ১১ মার্চ সেনানিবাসে হাসনাত আবদুল্লাহসহ দুজনের কাছে এমন একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ লিখেছেন, ‘আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদের বলা হয়, ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো। ফলে আপনি দেখবেন, গত দুই দিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছেন।

এই স্ট্যাটাসের শেষ অংশে হাসনাত আবদুল্লাহ লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারলে জুলাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমাদের শহীদদের রক্ত আমরা বৃথা হতে দেব না। আগস্টের পরের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কামব্যাকের আর কোনো সুযোগ নেই; বরং আওয়ামী লীগকে অবশ্যই নিষিদ্ধ হতেই হবে।

হাসনাত আবদুল্লাহ এই স্ট্যাটাসের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরাও ফেসবুকে বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেন। নানামুখী আলোচনার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন একদল শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানামুখী আলোচনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টার প্রতিবাদ গণহত্যার দায়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়।

ঘটনার পর শুক্রবার রাতে রাজধানীর বাংলামোটরে অস্থায়ী কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকা-ের বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই। খুনিদের বিচারের কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে হবে। ছাড়া আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আওয়ামী লীগ এখন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নয়, ফ্যাসিবাদী দল। জুলাই হত্যাকা-ের বিচার চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সময়আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেইবলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক . মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী  লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া বা না দেওয়া নিয়ে এই ইস্যুতে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। হত্যা-লুটপাটে জড়িত নয়, এমন কারও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাধা নেই বলে মন্তব্য করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বিচার নিয়ে কথা হচ্ছে না। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের পর আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর জনগণ ক্ষমা করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

অন্যদিকে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে পতিত ফ্যাসিবাদীরা দেশের ভেতরে এবং বাইরে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে অভিযোগ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। শুক্রবার ইস্যুতে ফেসবুক পোস্টে জামায়াতের আমির লেখেন, ‘আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ৩৬ জুলাই ক্লোজড হয়ে গিয়েছে। নতুন করে ওপেন করার অবকাশ নেই। জনগণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই গণহত্যার বিচার দেখতে চায়। এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সর্বস্তরের জনগণকে সংযত, সতর্ক ঐক্যবদ্ধ থেকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানাই।

অপরদিকে, শুক্রবার বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত ফিলিস্তিনে গণহত্যাবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, আওয়ামী লীগকে দেশের রাজনীতিতে আসতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে আসতে হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার পিলখানা গণহত্যা থেকে শুরু করে শাপলা চত্বর, মোদিবিরোধী আন্দোলন, জুলাই অভ্যুত্থানে যে গণহত্যা চালিয়েছে, সেসবের বিচার ব্যতিরেকে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নাম নিশানা দেশের মানুষ বরদাশত করবে না। আমরা আর কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি চাই না।

যুব ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া শুক্রবার বিকেলে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, অনিশ্চয়তা তৈরি হবে- এসব শঙ্কার কথা বলে কেউ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে জনতার ঐক্যে ফাটল ধরাতে আসবেন না।

বিভিন্ন দলের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমা প্রভাবশালী বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলো কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। ওই দেশগুলোর এই অবস্থান বিএনপি, জামায়াতসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ। যেহেতু এই দুই দলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে, তাই তাদের পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চলতে হয়। ওই বিদেশীদের চাওয়া সব সময় তাদের উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি কৌশল হতে পারে। সরকারের এই অবস্থান হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করার জন্য। তারা চায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করেও রাজনৈতিক মেরুকরণ বজায় রাখতে। কেননা সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

×