ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১

নির্ভীক সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদের বর্নাঢ্য জীবনের এক ঝলক

সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু, ক্যালিফোর্নিয়া সংবাদ প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ১৯:৪০, ২২ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ১৯:৪০, ২২ মার্চ ২০২৫

নির্ভীক সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদের বর্নাঢ্য জীবনের এক ঝলক

নির্ভীক সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদ

বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদ প্রকাশে অকুতোভয় নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ একজন সাহসী ও নীতিবান আপোসহীন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান মাসুদের ২২ শে মার্চ ছিলো তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। জনকন্ঠ ভবনেই তিনি কর্মরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন । মৃত‍্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৭০ বছর।

যে কোন একজন পত্রিকার সম্পাদকের কিছু গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন সবসময়ই দায়িত্বশীল গূরূত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। যারমধ্যে প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনামটি কি হবে তা নির্বাচন করা। শুধু তাই নয়, পত্রিকা প্রকাশের পূর্ব মূহূর্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও পত্রিকার সম্পাদকের ওপর নির্ভর করে । পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতার সংবাদ শিরেনামগুলো,  পেস্টিং ইত্যাদি নানাবিধ কাজ একজন সম্পাদকের দায়িত্বের ওপরই বর্তায়। জনকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ তিনি ব্যক্তিগতভাবে পত্রিকা প্রকাশের পূর্বরাতে বাসা থেকে বের হয়ে জনকন্ঠ ভবনে যেয়ে নিজের তদারকীতে পত্রিকার এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো সম্পন্ন করতেন। কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসতে মধ্যরাত কেটে যেতো। যুগের পর যুগ আর এ নিয়মের কখনো কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

আতিকুল্লাহ খান মাসুদের দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতায় বর্নাঢ্য জীবনের এক ঝলক:

১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার মেদিনীমণ্ডল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার এই অকাল মৃত্যুর ফলে পরিসমাপ্তি হলো বটবৃক্ষের মতো সুরক্ষিত আবরণে আচ্ছাদিত পত্রিকাটির মূল নিয়ন্ত্রক ও সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদের, এক বর্নাঢ্য জীবনের অবসান। একজন শিল্পপতি ছাড়াও তিনি ছিলেন, একজন সাহসী গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

‘নীতির সঙ্গে আপোষ নয়’ আতিকুল্লাহ খান মাসুদের দেয়া এই জনকন্ঠ পত্রিকার শিরোনাম শ্লোগানকে মূলমন্ত্র অন্তরে ধারণ করে জনকন্ঠ পরিবারের  সকল সদস্যরা অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর রেখে যাওয়া পদচিহ্ন অনুসরণ ও স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, জনকন্ঠ শিল্প পরিবারের প্রতিটি সদস্য কর্মচারী ও উত্তরসূরীরা নতুন আশার আলো নিয়ে আজোও নানা প্রতিকূলতার মধ‍্য দিয়ে দিবারাত্র প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আতিকুল্লাহ খান মাসুদের অবর্তমানে জনকন্ঠ পত্রিকাটি অত‍্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠানের সকল কার্য‍্যক্রমের দায়িত্বভার পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন প্রয়াত আতিকূল্লাহ খান মাসুদের সহধর্মিনী, শামিমা এ. খান। 

আতিকুল্লাহ খান মাসুদ  অনেক অসহনীয় নির্যাতনের স্বীকার হয়েও নীতির সঙ্গে তিনি কখনো আপোষ করেননি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় তিনি প্রতিবাদ করেছেন।
 
১৯৯৩ সালের পর থেকে বিংশ শতাব্দির এ দীর্ঘকালীন সময়টি ছিলো জনকন্ঠ পত্রিকার জন্য অনেক ঘটনাবহুল জীবন কাহিনী। নতুন চিন্তাভাবনাকে সামনে রেখে এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে চ্যালেন্জ হিসাবে গ্রহন করে মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদ দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ৯০-র দশকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ১৯৯৩ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস পালনের এক গৌরবময় দিনে গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জনাব আতিকুল্লাহ খান মাসুদ বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি জনগনের কাছে উপহার দেন- ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ পত্রিকা। 

বাংলাদেশে অন্যান্য প্রতিযোগী সংবাদপত্রের কাছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে এবং সাহসী সাংবাদিকতায় এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে জনকন্ঠ পত্রিকা। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় পত্রিকাটি অতি অল্প সময়ে এক বিশাল নিজস্ব পাঠক সৃস্টি করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের লক্ষ্য কোটি পাঠকদের কাছে আস্হা আর গ্রহনযোগ্যতার কারনে পত্রিকাটি রাতারাতি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্হান নেয়। 

২০০১ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্হিতিশীল পরিবেশের সময়কালীন বিএনপি আর জামাত-শিবিরের আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের নির্যাতনের খবরাখবর প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক প্রথম সারির পত্রপত্রিকাগুলো অনেকটা নিরবতার ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজও দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকা অত‍্যন্ত সরব।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও এবং নীতির প্রশ্নে অনড় আপোষহীন সাহসী সাংবাদিকতা ভূমিকা পালনের কারনে জনকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, আতিকুল্লাহ খান মাসুদকে অনেক নির্যাতন ও জেল-জুলুমও সহ্য করতে হয়েছিলো। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি নিজে এবং তাঁর পরিবার। দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকা ভবন একেবারে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ঢাকায় জনকন্ঠের ভবন বোমা স্হাপন করা হয় । যড়যন্ত্রকারীরা কন্ঠরোধ করার জন্য তাঁর নিজস্ব বাসগৃহে বুলডোজার দিয়ে বাড়ী ভাঙার চেস্টা, পরিবারকে হত্যা, ভয় ও ভীতির মাধ্যমে বিভিন্ন হয়রানী করার চেস্টা করা হয়। কিন্তু কোনকিছুই জনকন্ঠ পত্রিকার কন্ঠরোধ করতে পারেনি। 

২০০৭ সালের ৭ মার্চ আনুমানিক রাত ১০.০০ টায় মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে জনকন্ঠ ভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ৪৫ কোটি টাকা জরিমানা, ৪২টি মিথ্যা মামলা এবং ৪৮ বৎসর কারাদন্ড প্রদান করে। আর এজন্যে তিনি প্রায় ২ বছর কারাবরণ ভোগ করেন। তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি এবং পরে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা ভিভিন্ন মামলাগুলো থেকে তিনি অব্যাহতি পান।  

৯০-র দশকে দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকা সমগ্র বাংলাদেশে একই সময় পাঠকদের হাতে পৌঁছুবার লক্ষ্যে পত্রিকা সরবরাহে তিনি এক যুগান্তকারী কাঠামোগত পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নেন। ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলো দেশের অন্যন্য শহর ও জেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্হার অপ্রতুলতার কারনে বিলম্বে পাঠকদের হাতে পৌঁছাতো। অনেক অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও চ্যালেন্জ হিসাবে পত্রিকা সরবরাহে তিনি এক নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া চালু করার চেস্টা করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রয়ারী সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসাবে তিনি দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকাটিকে সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশের ৪টি স্থান থেকে একই সাথে প্রকাশ করে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ব্যাপক আলোড়ন সৃস্টি করেন। যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র দৈনিক পত্রিকা USA TODAY সে একই পদ্ধতিতে  সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলোতে একযোগে পত্রিকাটি পাঠকদের হাতে পৌঁছে যেতো। 

মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলা কমান্ডার হিসাবে আতিকুল্লাহ খান মাসুদের গেরিলা অপারেশনের লোমহর্ষক স্মৃতিচারণ: 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরের অধীনস্থ মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা কমান্ডার হিসাবে আতিকুল্লাহ খান মাসুদ সক্রিয়ভাবে অনেক বড় বড় গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। জীবনবাজি রেখে সম্মুখ গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবগাঁথা ইতিহাস রয়েছে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল্লাহ খান মাসুদের। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধের অনেক গৌরবগাঁথা দু:সাহসী অভিযানের ঘটনাবলী আজও ইতিহাস হয়ে আছে। তেমনি একটি অ্যামবুশ অপারেশনের দূধর্ষ  ঘটনা পাঠকদের অবগতির জন্য উল্লেখ করতে তাই। 

আতিকুল্লাহ খান মাসুদ মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর ‘থানা কমান্ডার’ হিসাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। খবর পেলেন, তাঁরই এলাকায় হানাদার পাক বাহিনীর সৈন্যরা গ্রামে এসে প্রায়ই ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ আর অগ্নিসংশোগ করে জনজীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। পরিকল্পনা করলেন, পাকবাহিনীর এ সেনা দলটিকে অতর্কিত আক্রমন করে পরাস্ত করতে হবে। তিনি সহযোগী অন্যন্য মু্ক্তিযোদ্ধাদের সাথে গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার দূধর্ষ এক পরিকল্পনাও তিনি স্হির করেন। কবে, কখন এবং কোথায় এ অপারেশন কার্যকর করা হবে, তার একটি রুপরেখা চুড়ান্ত করা হলো। আক্রমণের চুড়ান্ত পরিকল্পনা সমাপ্ত হবার পর, কমান্ডার মাসুদ সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশনের জন্য নিজের দলকে প্রস্তুত করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী যে রাস্তা দিয়ে পাক বাহিনী সচরাচর গাড়ী নিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করে ঠিক তার পাশে একটা বিশাল অংশ জুড়ে ছিলো, কচুরীপানায় পরিপূর্ন একটি পুকুর। গেরিলা অপারেশনের জন্য তিনি কচুরীপানা পরিপূর্ণ এ পুকুরটিকে আক্রমণের জন্য উত্তম স্হান হিসাবে বেছে নেন। তার কারণ, পাক বাহিনীর জীপ গাড়ীটি এই কচুরীপানা পরিপূর্ণ পুকুরের পাশ ঘেঁষে সবসময় পার হতে হয়। চলাচলের অন্য কোন বিকল্প ছিলোনা। শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে যাবার কৌশল হিসাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মিশে যাবার জন্য তিনি মুখে ও শরীরে কচুরী পানার সদৃশ্য সবুজ রঙ্গ মেখে অপারেশনের জন্য সকলকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন। এ যেনো অনেকটা হলিউডের বিখ্যাত তারকা সিলভেস্টার স্ট্যালোন  অভিনীত জনপ্রিয় ‘রেম্বো’ ( Rambo) ছায়াছবির একটি বিশেষ অ্যামবুশ হামলার দৃশ্যের কথা আমাদের অনেক চলচ্চিত্র প্রেমিক দর্শকদের মনে করিয়ে দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আঁধো ডুবন্ত অবস্হায় হাতে গ্রেনেড নিয়ে সকলে পুকুরের কচুরীপানা পরিবেস্টিত পুকুরে অবস্হান নেবে। যাতে দূর থেকে শত্রুপক্ষ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সহজে সনাক্ত করতে না পারে সে জন্যে বিশেষ পরিধেয় জামা কাপড় পড়ার নির্দেশ দিলেন।  কমান্ডার মাসুদ তিনি কচুরীপানা পরিপূর্ন পানিতে খালি গায়ে পরিধেয় লুঙ্গীতে কোচ মেরে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। আর মূখে ও সর্বাঙ্গে তিনি সবুজ রঙ মেখে এবং মাথায় বেশ কিছু কচুরীপানা দিয়ে টুপীর মতো বসিয়ে দিলেন। সাথে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারাও যে যার মতো সকলেই সে সাজে সজ্জিত হবার প্রস্তুতি নিলেন। কমান্ডার মাসুদ আক্রমণের নির্দেশগুলো সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্তারীত বুঝিয়ে দেন। আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী বলা হলো, পাক বাহিনীর সেনা সদস্যদের গাড়ী বহর যখনই আমাদের নাগালের মধ্যে আসবে আমিই প্রথম গ্রেনেডটি তাদের ওপর ছুঁড়বো আর সেটাই হবে সকলের জন্য সবুজ সংকেত একযোগে উপর্যপূরী ওপর একের পর এক উপর্যপূরী হানাদার পাক বাহিনীর ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারা। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

হঠাৎ শুনতে পাওয়া গেলো দূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীন গাড়ী এগিয়ে আসার শব্দ। কমান্ডার মাসুদ নিম্নস্বরে সকলকে যে যার মতো অবস্হান আর প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন। ক্রমশই পাক সেনাদের জীপ গাড়ীটি ধীরে ধীরে গ্রামের সে মেঠো পথ ধরে এগিয়ে আসছে। দূর থেকে ভেসে আসছে জীপ গাড়ীর কাছে এগিয়ে আসার শব্দ।

চুড়ান্ত সময়ের জন্য সকলেই প্রস্তুত। পিনপতন শব্দ। জনশূন্য রাস্তা। মিলিটারী গাড়ীর শব্দ শুনতেই সকলেই ভয়ে ঘরের কোনে জীবন বাঁচাবার জন্য যে যার সৃস্টিকর্তার স্মরণ করতে থাকে। জীপ গাড়িটি শব্দ শুনে মনে হচ্ছে গাড়ীটা অনেকটা কাছাকাছি এসে গেছে । মুক্তিযোদ্ধারা শেষ বারের মতো গ্রেনেডের পিন পরখ করে নিলেন চুড়ান্ত আঘাত আনার জন্য। সামান্যতম ভূল মানে, মৃত্যু দূতের কাছে একেবারে ওয়ান-ওয়ে টিকেট। কমান্ডার মাসুদ শেষ বারের মতো আর একবার একটু মাথা উঁচু করে পাক সেনাদের অবস্হান দেখে নেবার চেস্টা করলেন। 

সকলের হাতে বেয়োনেট আর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্র নিয়ে পাক বাহিনী বোঝাই গাড়ী সে কচুরীপানা পুকুর সড়কের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। থমথমে পরিবেশ। সকলের অপেক্ষা করছে কমান্ডার মাসুদের চুড়ান্ত সংকেতের। সে এক স্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। অবশেষে যে মাহেন্দ্রক্ষেনের জন্য সকলেই অপেক্ষা করছিলো সেটার সংকেত পাওয়া গেলো কমান্ডার মাসুদের কাছ থেকে।পাক বাহিনীর সেনা সদস্যদের গাড়ী বহর নাগালের কাছে আসার সাথে সাথেই কমান্ডার মাসুদ আচমকা পুকুরের কচুরীপানার মধ্যে থেকে উঠে পাক সেনাদের গাড়ী লক্ষ্য করে সরাসরি গ্রেনেড ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ ও চিৎকার। আর কালবিলম্ব না করে অন্য সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারাও ‘জয় বাংলা’ চিৎকার করে একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে পাক সেনাদের লক্ষ্য করে। ধরাসায়ী হয় পাক হানাদার বাহিনী সে অপারেশনে। কমান্ডার মাসুদের বিচক্ষন পরিকল্পনার কারনে, সে অ্যামবুশ অপারেশন ছিলো, একটি সফল স্বাশরুদ্ধকর অপারেশন।

অভিবাদন জানাই, এ মহান সাহসী মুক্তিযাদ্ধা এবং শিল্পপতি আতিকুল্লাহ খান মাসুদকে। দেশপ্রেম আর দেশব্যপী কর্মসংস্হানের সূযোগ সৃস্টির মধ্যে দিয়ে তিনি  একজন নাগরিক হিসাবে দায়িত্ববোধ পালনের, এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ইতিহাস জনকন্ঠ পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারে ও সম্প্রসারনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রয়াত আতিকুল্লাহ খান মাসুদের নিজ হাতে গড়ে তোলা “গ্লোব জনকন্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড” অবস্থানগতভাবে বাংলাদেশে সফল, সুপরিচিত ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে একটি অন্যতম বহুমূখী প্রতিষ্ঠান হিসাবে আজো সকলের কাছে সমাদৃত -একটি শিল্প পরিবার।

সবশেষে, দোয়া করি আল্লাহ যেনো ওঁনাকে বেহেস্তের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমিন।


মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান মাসুদ ছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক এবং গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান। জীবনের শেষদিনও তিনি কর্মরত অবস্থায় জনকণ্ঠ অফিস ভবনে পত্রিকার কাজে ব‍্যস্ত ছিলেন। ২০২১-এর ২২ মার্চ সোমবার ভোরে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে বাসভবনের নিকটস্থ একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষনা করেন।

বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক অনন‍্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে চিরদিন। কারণ, তিনি এমন ভূমিকা পালন করেছেন যা অন্য কোনো সম্পাদক ও সংবাদপত্র উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আত্মপ্রকাশকালে দৈনিক জনকণ্ঠ সত্যিকারার্থেই হয়ে ওঠে জনতার কণ্ঠ। সামরিক স্বৈরাচারের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে নিয়ে গণমাধ্যমকে এগিয়ে নেওয়া ছিল কঠিন কাজ। দেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন সমস্ত শুভবোধকে গ্রাস করে ফেলেছিল, সেই সময়ে অকুতোভয় গণমাধ্যম হিসেবে জনকণ্ঠ অত্যন্ত প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছিল তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। প্রায় তিন দশক আগে যখন যাত্রা শুরু করেছিল জনকণ্ঠ, তখন একযোগে ঢাকাসহ পাঁচটি অঞ্চল থেকে মুদ্রণ ও প্রকাশ হতো জনকণ্ঠ। ফলে, রাজধানীর সংবাদপত্র পাঠকের মতোই প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাঠকের হাতেও সাতসকালেই পৌঁছে যেত জনকণ্ঠ। তখন দেশ ডিজিটাল ছিল না। ছিল না ইন্টারনেট। এমনকি কম্পিউটারের ব্যবহারও ছিল সীমিত। এমন একটি সময়ে দেশের নানা স্থান থেকে একযোগে দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের মৌলিক চিন্তা এবং তা বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ অনন্য অদ্বিতীয় ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ থেকে তাঁর আধুনিক মানস এবং গণমাধ্যমের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা তথা দেশপ্রেম আরও একবার সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দুঃখজনক হলো, ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার তাঁকে ৪২টি মিথ্যা মামলায় ২২ মাস ১২ দিন কারান্তরীণ রাখে অন্যায়ভাবে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান সাংবাদিকদের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে তাঁর হৃদয়ের বিশালত্বের প্রসঙ্গ। এমন একজন সম্পাদকের কখনই মৃত্যু হতে পারে না। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর যুগান্তকারী ভূমিকা ও অবদানের জন্য। একাত্তরে তিনি যেমন ছিলেন একজন নির্ভীক বীর মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি স্বাধীন দেশেও তিনি সাহসী কর্মবীর হিসেবেই তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। একইসঙ্গে আমরা গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের কর্মীবৃন্দ আজকের দিনে মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা-সম্পাদককে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।

আশিক

×