
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এ দেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটির অধিক। ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩১,০০০ জন/ প্রতি বর্গকিলোমিটারে আর দেশে ১,১৩১ জন/ প্রতি বর্গকিলোমিটারে। এরকম একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অনেক সামাজিক সমস্যা আছে। তারমধ্য যেখানে-সেখানে থুতু নিক্ষেপ একটি মারাত্মক সমস্যা। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মানুষের থুতুতে উক্ত ব্যক্তির মধ্যে থাকা রোগের জীবাণু থাকে। ফলে সেই জীবাণু বাতাস বা স্পর্শের মাধ্যমে অন্য মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
তাছাড়া যাদের পেটে কৃমি আছে তাদের মধ্যে থুতু ফেলার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ফলে থুতু ফেলার প্রবণতা দেখা দিলে কৃমির চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। তাই থুতু নিক্ষেপ সাধারণ একটি বিষয় বলে তুচ্ছজ্ঞান করা মোটেই ঠিক হবে না। যিনি প্যাচ প্যাচ করে থুতু ফেলেন, তিনি হয়তো বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নন। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বেশি লোক সমাগমের স্থান হলো - ফার্মগেট, গুলিস্তান, মিরপুর ১০, যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজার ইত্যাদি। এই জায়গাগুলোতে কোন একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে যদি আপনি যদি লক্ষ করেন, দেখবেন মানুষ এ বিষয়ে কতটা অসচেতন। ভিড়ের মধ্যে যেতে যেতেও থুতু ফেলছেন। পাশের মানুষের তোয়াক্কাই করছেন না। কারও গায়ে থুতু পড়তে পারে- এ বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) বিশ্বজুড়ে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটা গবেষণা করেছিল। তারা জানায়, ভাইরাসভরা থুতুর ছিটা (ড্রপলেট) স্বল্প দূরত্বে থাকা মানুষকে রোগাক্রান্ত করতে পারে।
ওই সময় তারা ১ হাজার ১২২ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছিল। তাদের ৯০৭ জনই যত্রতত্র কাশে-হাঁচে, কফ-থুতু ফেলে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের(সিডিসি) দেওয়া তিনটি পরামর্শ মেনে চলার কথা বলে। তার একটি আমরা কোভিড-১৯–এর সময় স্বাস্থ্য বুলেটিনে প্রতিদিন শুনতাম, ‘হাঁচি–কাশির শিষ্টতা মেনে চলুন’।
গাড়ি, বাসে চলাচলরত মানুষজন অসচেতনভাবে থুথু ফেলছেন। কেউ কেউ থুথু ফেলার আগে বিকট, বিশ্রী শব্দ করে মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করেন।
সাহিত্যে থুতু নিক্ষেপের ঘটনা খুব একটা পাওয়া যায় না। প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ ও ঘৃণার বশবর্তী না হলে এমনটা হয় না। "লালসালু" উপন্যাসে মজিদের ওপর জমিলার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও মাজার প্রথার প্রতি ঘৃণা থেকেই মজিদের মুখে থুতু নিক্ষেপ করে জমিলা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "দুটি অভিশাপ" কবিতায় তিনি সাগরে থুতু ফেলে আত্মগ্লানিতে বলেছেন,
‘সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম/ কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি/
প্রবল ঢেউ-এর মাথায় ফেনার মধ্যে/
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু/
তবু আমার লজ্জা হয়,/
এত দিন পর আমি শুনতে পাই/
সমুদ্রের অভিশাপ।’
বাংলাদেশে একাধিক আইনে প্রকাশ্যে থুতু ফেললে জরিমানার বিধান আছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর ৬০(১) ধারায় বলা আছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পিকদান থাকতে হবে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। আরও বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের আঙিনার মধ্যে কেউ বাক্স ও পিকদান ছাড়া ময়লা বা থুতু ফেলতে পারবেন না। ফেললেই শাস্তি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সে থুতু ফেললে ১০০ টাকা এবং সিলেট ও বরিশালে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান আছে। আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগ নেই।
রাজনীতিতেও থুতু নিক্ষেপর ঘটনা ঘটে। অধুনা ধর্ষণবিরোধীদের একটি মিছিল থেকে পুলিশের ওপর থুতু ছিটানোর অভিযোগ উঠেছে।
জীবজগতে মানুষ ছাড়া আর একটি প্রাণী থুতু নিক্ষেপ করে- আর তা হলো স্প্লিটিং কোবরা। কেবল বিপদে পড়লেই সে এটি করে। কিন্তু মানুষতো সেরা জীব। সে কেন এরকম একটি কাজ বিনা প্রয়োজনে করছে?
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জনগণ এ বিষয়ে সচেতন। তারপরও থুতু না ফেলার জন্য সচেতনতা তৈরি করা হয়। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা পিছিয়ে থাকবো কেন? এ দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। জনসচেতনতার জন্য প্রচার- প্রচারণা, পোস্টার, লিফলেট দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম।
সামাজিক সমস্যামূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ছাপানো, টকশো আয়োজন করে উনারা জনসচেতনতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। ছোট ছোট বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সহজে সচেতন করা সম্ভব।
সরকারেরর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। ঢাকা শহরের একটি রাস্তাকে থুতু মুক্ত রাস্তা ঘোষণা করে কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।
কারও ঠাণ্ডা লাগাসহ যৌক্তিক কারণে থুতু ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। তাদের জন্য রাস্তার মোড়ে ময়লার বিন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকবে।
আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। নিজের ও দেশের প্রয়োজনে আসুন সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে পারিপার্শ্ব পরিষ্কার রাখি।
শিহাব