ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

নকল করতে ব্যবহার হচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তি

ঈদের আগে সক্রিয় জাল নোট চক্র

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:২২, ২২ মার্চ ২০২৫

ঈদের আগে সক্রিয়  জাল নোট চক্র

.

উচ্চ বেতনের গ্রাফিক্স ডিজাইনার আর উন্নতমানের কম্পিউটার, প্রিন্টার, হিট মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন, ডাইস, জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা, প্রিন্টারের দামি কালি, আঠা স্কেল কাটার ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে ছাপা হয় জাল টাকা। কম্পিউটার এক্সপার্ট টাকার জলছাপ থেকে শুরু করে  নিরাপত্তা সুতাসহ অন্য সবই অনেকটা হুবহু নকল করে। টাকা ছাড়াও মার্কিন ডলার, ভারতীয় রুপিও জাল করে। এর পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে এসব জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে। ফেসবুকে পেজ গ্রুপ খুলেও জাল টাকা বেচাকেনার প্রচারণা চালানো হয় প্রকাশ্যে, দেওয়া হয় হোম ডেলিভারি। এসব জাল টাকা বাজারজাত করণের জন্য বেছে নেওয়া হয়সময় যে সময় ক্রেতা-বিক্রেতা অন্য সময়ের তুলনায় ব্যস্ত থাকবে। সেটি হলোঈদের সময় ঈদ ঘিরে মার্কেটে পাইকারি খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতারা ব্যস্ত থাকেন। তখন হাজার হাজার টাকার মধ্যে /১টি জাল নোট চালিয়ে দিতে পারলেই চক্রের লাভ। আর এভাবেই ঈদে লেনদেন কেনাকাটায় ক্রেতা-বিক্রেতার তাড়াহুড়ার মাঝে চালিয়ে দেওয়া হয় জাল নোটগুলো। এক্ষেত্রে সময় নিয়ে টাকা চেক করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অভিযান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বছরই চক্রগুলো জাল নোট তৈরি করলেও ঈদকে বেছে নেয় তারা। ঈদের আগে সরকারিভাবে নতুন টাকা ছাপা হয়। জাল টাকার চক্রগুলোও নতুন জাল নোট ছাপে। এতে চকচকে আসল টাকার মধ্যে /১টি চকচকে জাল নোট ঢুকিয়ে দিলে সেটি অনেকেই ধরতে পারেন না। তা ছাড়া ঈদে ক্রেতা-বিক্রেতা তাড়াহুড়ার মধ্যে আসল না নকল সেটি একটু কম পরীক্ষা করে থাকেন।     

প্রতিবছর ঈদ এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকা তৈরি চক্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ঈদের সময় এই চক্রের বিষয়ে সতর্ক থাকে। বছরের অন্যান্য সময় এই জাল টাকার চক্র যেমন চুপ থাকে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এদিকে তেমন নজর দেয় না। এবারও ঈদের আগে দুটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তারা বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে উন্নতমানের সরঞ্জাম দিয়ে জাল টাকা ছাপাত। দুই চক্রের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে আগেও একাধিক মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় জামিনে বেরিয়ে ফের অপকর্মে যুক্ত হয় তারা।

গত ১৭ তারিখে রাজধানীর আর কে মিশন রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩৮ লাখ জাল টাকা, ভারতীয় রুপিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি উত্তরা বিভাগ। তাদের কাছ থেকে জাল টাকা ছাপানোর সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়। মূলত বাসা ভাড়া নিয়ে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে কাজটি করে আসছিল। এর মধ্যে সাইদুর রহমান (৩২) মেহেদী হাসান (২৫) নামে দুজন গ্রেপ্তার হলেও কৌশলে পালিয়ে যায় আরেকজন। যার বিরুদ্ধে জাল টাকা ছাপানোর অভিযোগে আগেও দুটি মামলা রয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) কামরুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, চক্রটি সারা বছর জাল টাকা ছাপত। বিভিন্ন পেশার আড়ালে বাসা ভাড়া নিয়ে তারা কাজ করত। এর মধ্যে পলাতক আসামির বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। সে জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০, ৫০০ ১০০০ হাজার টাকার নোট উদ্ধার করা হয়েছে। মূলত জাল টাকা ছাপানোর পর চক্রের এজেন্টদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এজেন্টদের থেকে আবার নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা জাল নোট কিনে নিত। এর পর নতুন টাকার সঙ্গে /১টি করে জাল নোট ঢুকিয়ে চালিয়ে দিত। তিনি বলেন, চক্রে কম্পিউটার গ্রাফিক্স এক্সপার্ট রয়েছে। তারা নিখুঁতভাবে টাকা জাল করে থাকে। উচ্চ বেতন দিয়ে তাদের রাখে চক্রগুলো।

এর ঠিক দুই দিন আগে কামরাঙ্গীরচর নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০ লাখ টাকার জাল নোট জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের লালবাগ বিভাগ। চক্রটি আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে জাল নোট তৈরি করে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মজুত করেছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- সুমন, সুলতানা হানিফ গাজী। এই চক্রেও রয়েছে গ্রাফিক্স ডিজাইনার।

লালবাগ বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, এদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদের বিরুদ্ধে আগেরও /৪টা করে মামলা রয়েছে। সেসব মামলায় জামিনে বেরিয়ে ফের জাল টাকা ছাপত। ডিসি বলেন, জাল টাকা তৈরি বিতরণের জন্য চক্রটি মূলত সময় বেছে নেয়। এই সময় হিসেবে তারা ঈদকে বেছে নেয়। কেননা, ঈদে ব্যবসাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদন হয়। খুচরা-পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতারা ব্যস্ত থাকেন। ব্যস্ততা আর তাড়াহুড়ার মধ্যে ভালোভাবে টাকা চেক করেন না অনেকে। ফলে ১০০০ টাকার একটা জাল নোট চালিয়ে দিতে পারলে পুরো টাকাই লাভ। আর চক্রের লাভ হয় ৯০ বা ১০০ টাকা। তাই ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে সময় নিয়ে টাকা চেক করে নেওয়া উচিত। 

তবে দুটি চক্র ধরা পড়ার আগেই বাজারে অর্ধ কোটি টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। ঈদে মার্কেট, পশুর হাটসহ অন্যান্য কেনাকাটায় যেমন জাল নোট ব্যবহার করা হয় আবার বছরজুড়ে মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনের সময় জাল নোট চালিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা।

চক্রগুলো বরাবরই ৫০০ কিংবা হাজার টাকার বড় নোট প্রিন্ট করে। কারণ এতে লাভ বেশি। হাজার টাকার নোট চালাতে পারলে পুরোটাই লাভ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি ১০০ পিস হাজার টাকার নোট অর্থাৎ এক লাখ নকল টাকা তৈরিতে খরচ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। সেই জাল টাকা চক্রগুলো পাইকারি ক্রেতার কাছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পরে পাইকারি ক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, এরপর প্রথম খুচরা ক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে আবার সেগুলো বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এবং সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতা মাঠপর্যায়ে দোকানে দোকানে গিয়ে বিভিন্ন নিত্যপণ্য কেনার মাধ্যমে সেসব জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে আসল এক লাখ টাকার সমপরিমাণ ভোগ করছে। কিন্তু এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ১০ ২০ টাকার নোটও জাল করে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে চক্রটি। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বড় নোট সব ক্রেতা-বিক্রেতা দেখেশুনে যাচাই করে নেয়। কিন্তু ১০, ২০, ৫০, ১০০ কিংবা ২০০ টাকার নোট বেশি একটা যাচাই না করেই লেনদেন করেন। এতে ছোট জাল নোট খুব সহজেই বাজারে ছড়াচ্ছে। ফেসবুক, টিকটক ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার সব বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। শুধু অর্ডার করলেই দেশের যে কোনো প্রান্তে হোম ডেলিভারির সুবিধাও রয়েছে।

দেখা যায়, ‘জাল টাকার কারখানা’ ‘জাল টাকা বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রি করা হয়’, ‘জাল টাকার ডিলার’, ‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডট কম’, ‘ডিলার জাল টাকারএমন নানা নামে পেজ রয়েছে ফেসবুকে। ছাড়া টেলিগ্রামেজাল টাকা’, ‘জাল টাকার লেনদেনজাল টাকা সেল গ্রুপনামে বিভিন্ন গ্রুপের সন্ধান মিলেছে।

এর মধ্যেজাল টাকা বিক্রি করা হয়নামে একটি ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, ‘আসসালামু আলাইকুম প্রিয় গ্রাহক, এই প্রথমবার আপনাদের জন্য ভালোমানের প্রিন্ট দ্বারা তৈরি করা নোট দিচ্ছি। সারা বাংলাদেশে হোম ডেলিভারিতে বুক করা হচ্ছে। যারা নোট নিতে ইচ্ছুক, তারা ইনবক্সে আসেন, আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ নোট আছে ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০। সুপার কোয়ালিটি মানসম্পন্ন নোট দিচ্ছি। যারা বারবার প্রতারিত হচ্ছেন তারা লাস্ট একবার ডিল করতে পারেন। সর্বনি¤œ ২৫ হাজার টাকা। এক টাকাও অগ্রিম দিতে হবে না, শুধু ডেলিভারি চার্জ দেবেন, বুকিং দিয়ে রিসিট পাঠিয়ে দেব। আরেকটি পেজে ১০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার জাল নোট বিক্রির প্রচারণামূলক পোস্ট দেওয়া হয়েছে। 

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল মল্লিক বলেন, যে কোনো উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে থানা পুলিশ গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয়েছে। সার্বক্ষণিক অনলাইন তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের শনাক্ত করে গোয়েন্দা জালে নেওয়া হচ্ছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আবার অনেকে আছে নজরদারিতে।

 

×