
দারিদ্র্য ক্রমশ গ্রাস করছে গোটা বিশ্বকে
দারিদ্র্য ক্রমশ গ্রাস করছে গোটা বিশ্বকে। উল্টোদিকে চীন এই অভিশাপকে পরাজিত করেছে সফলভাবে। ১৪০ কোটির বেশি মানুষের দেশটি কিভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে সেটার জ¦লন্ত উদাহরণ ইউনান প্রদেশের নুজিয়াং প্রিফেকচার (স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল)। নুজিয়াংকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পা রাখতে পারে উন্নয়নের সিঁড়িতে। এজন্য প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর কঠিন পরিশ্রম।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডার দারিদ্র্য হ্রাস লক্ষ্য নির্ধারণের ১০ বছর আগেই অঞ্চলটিকে চরম দারিদ্য থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে শুধুমাত্র বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। মাইলের পর মাইল পাহাড় কেটে টানেল তৈরি করাসহ পাহাড়ের গাঁ ঘেষে চাষাবাদ করাও এই প্রচেষ্টার অংশ ছিল। কঠোর শ্রম ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারই চীনকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। দেশটিতে রয়েছে ৫৪টি স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী। এছাড়া আরও কয়েকটি নৃগোষ্ঠী রয়েছে দেশটির আনাচে-কানাচে। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে নেই কেউই।
জানা গেছে, নুজিয়াং ছিল দেশটির অত্যন্ত দরিদ্র একটি এলাকা। কিছুদিন আগেও এই অঞ্চলের ৯৮ শতাংশ জমি উঁচু পাহাড় এবং প্রশস্ত উপত্যকা ঘেরা ছিল। চাষযোগ্য জমির ৭৬ শতাংশ ছিল বিশাল ঢালে। ২০১৮ সালেও এই অঞ্চলে বা প্রিফেকচারে এক লাখ ৬৪ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, অর্থাৎ এর গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩৮.১৪ শতাংশ। এখানে ২২টির মতো নৃগোষ্ঠী যেমন লিসু, ন্যু, পুমি, ডুলংরা বসবাস করত।
মোট জনসংখ্যার ৮৯ শতাংশই নৃগোষ্ঠীর। এর মধ্যে ডুলং এবং ন্যুরা নুজিয়াংয়ের কাছাকাছি বাস করে। আর লিসু এবং পুমিরা মূলত নুজিয়াংয়ের বাসিন্দা। এলাকাটি স্বায়ত্ত্বশাসিত এবং ৬২ শতাংশই সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর মানুষ। বছরের পর বছর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। পাহাড়ের গাঁ ঘেষে অথবা পাহাড়ের ধারেই বাস করত অধিকাংশ মানুষ। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
পাহাড় ছেড়ে অধিবাসীরা এখন নির্মিত গ্রামে বসবাস করছে। ২০২০ সালের পর থেকে নুজিয়াংয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আধুনিক জীবনযাত্রার যাবতীয় ছোঁয়া এখন নুজিয়াংয়ের অধিবাসীর মাঝে।
নুজিয়াং বর্তমানে হাইড্রোকার্বনে পরিপূর্ণ, মোট ২০ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এই এলাকা বিশ্বমানের জিংক খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এবং কপার, লৌহ, সোনা এবং সিলভারও রয়েছে এলাকাটিতে। এতসব সম্পদ থাকার পরও নুজিয়াং গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দুটি প্রধান দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। প্রথমটি ছিল মানুষের বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত গ্রামগুলোকে এমন জায়গায় স্থানান্তর করা যেখানে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা ছিল।
সরকার স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা সুবিধার পাশাপাশি কর্মশালাসহ স্থানান্তর সম্প্রদায় নির্মাণের জন্য অর্থায়ন করেছিল। এই সমস্ত কিছু একটি মসৃণ স্থানান্তর এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করেছিল, স্থানান্তরিতদের তাদের জীবন উন্নত করার উপায় প্রদান করেছিল।
দ্বিতীয় কৌশল ছিল আরও কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং উন্নয়নের জন্য পরিবেশ উন্নত করা। এই নীতির মাধ্যমে নুজিয়াং পর্যটন ও সংস্কৃতি, মসলা, উপত্যকা কৃষি এবং জৈব চিকিৎসার মতো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্প গড়ে তুলেছিল। এই দুই কৌশলই নুজিয়াংকে এগিয়ে নিয়েছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রিফেকচারটি চরম দারিদ্র্য দূর করে ফেলে, যেখানে পূর্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীরা খাদ্য ও পোশাকের উদ্বেগ থেকে মুক্ত ছিল এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা, মৌলিক চিকিৎসা পরিষেবা এবং নিরাপদ আবাসনের নিশ্চয়তা পেয়েছিল।
শুরুতে বছরের পর বছর পাহাড়ে জীবন কাটানো মানুষদের এনে নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠা করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখন যেখানে তাদের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানে রয়েছে পরিপূর্ণ নাগরিক সুবিধা। আধুনিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বয়স্কদের জন্য মান্দারিন ভাষা এবং স্বশিক্ষিত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রতিষ্ঠানে বয়স্করা ছবি এঁকে এঁকে নতুন করে ভাষাসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিজেকে যোগ্য করে তুলছেন। শিক্ষার পাশাপাশি তাদের রয়েছে সাংস্কৃতিক বিনোদনের ব্যবস্থা। গানের মাধ্যমে তারা নিজেরা শিখছেন, অপরকে শেখাচ্ছেন। আর সবই পরিচালিত হচ্ছে দক্ষ কর্মীদের দ্বারা।
সরেজমিনে প্রিফেকচার ঘুরে দেখা গেছে, বয়স্করা যেখানে শিক্ষা, বিনোদন আর খেলাধুলার মাধ্যমে দিন অবিবাহিত করছে, ঠিক বিপরীতে কর্মক্ষম এবং নারীরা কুটিরশিল্পের মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন। উদাহরণ হিসেবে বেসবল তৈরির একটি কারখানায় কাজ করছেন শতাধিক নারী। বল হাতে সেলাই করে মজুরি হিসেবে একজন পেয়ে থাকেন তিন চীনা মুদ্রা (আরএমবি)।
প্রতিদিন একজন নারী ১৫০টির বেশি বল সেলাই করতে পারে। সেই হিসেবে একজন নারীর দৈনিক মজুরি দাঁড়াচ্ছে ৪৫০ আরএমবি। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য সাত হাজার ৯২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন শুধুমাত্র বল সেলাই করে একজন নারী এই পরিমাণ টাকা উপার্জন করছেন। শুধুমাত্র বল সেলাই করাই তাদের কাজ। বাইরের কোম্পানির মাধ্যমে তারা এই কাজ পেয়ে থাকেন। এভাবেই নুজিয়াংয়ের মেয়েরা এগিয়ে চলছেন। আর পুরুষ করছেন অন্যান্য কাজ ও চাকরি।
নুজিয়াংয়ের মানুষের জন্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোকেশনাল এবং টেকনিক্যাল কলেজ। এই কলেজটিতে শিক্ষার্থী রয়েছে কয়েক হাজার। শিক্ষক রয়েছেন দুশ’র বেশি। কলেজে বেসিক মেডিসিন, সাংস্কৃতিক বিকাশ, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এবং ট্যুরিজম ও ঐতিহ্যবাহী চা ও কফি প্রস্তুতের শিক্ষাও হাতে কলমে দেওয়া হয়ে থাকে। পর্যটনকে সামনে রেখে স্থানীয়দের দেওয়া হয় বিভিন্ন হসপিটালিটির শিক্ষা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কলেজের ভেতরে হোটেলের রুমের পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে হাতে কলমে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। এভাবেই পর্যটনকে সেখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিতরা গ্র্যাজুয়েশন এবং শিক্ষা শেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজের জন্য যোগ্যদের পাঠিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানে রয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে শিক্ষকরা নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এবং পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে নিয়মিত চর্চা করে থাকেন। এভাবেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিজেদের এগিয়ে নিতে সব সময়ই শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোর মধ্যে রাখেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত নুজিয়াংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন শিল্প। মি জিং জিয়াগু হচ্ছে একটি কফির কারখানা। এটি নুজিয়াংয়ে স্পাইসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত। কারখানাটির মালিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক সম্পন্ন করে চাকরিকে বেছে না নিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করছেন তার স্ত্রী।
পৃথিবীর জনপ্রিয় সব কফির চাষ করে গাছ থেকে কফি বীজ সংগ্রহ করে তিনি নিজস্ব এলাকাকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এলাকাতে তিনি সফল কফি প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ী পরিচিতি পেয়েছেন। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এবং কারখানার মধ্যেই তিনি চাষ করেছেন জনপ্রিয় সব কফি গাছ। ফল পেয়েছেন হাতেনাতেই। এভাবেই পরিবেশ ও পাহাড়কে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নুজিয়াং। যেটি রীতিমতো শুধু চীন নয় গোটা বিশ্বের কাছেই রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেক্ষেত্রে যোগাযোগ বিপ্লব ও মানুষের কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে নীতিনির্ধারক সঠিক পরিকল্পনা সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। সেই কারণে নুজিয়াং হতে পারে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রকৃষ্ট উদহারণ। চীনের ইউনান প্রাদেশিক সরকারও চায় বাংলাদেশের সঙ্গে নুজিয়াংয়ের সাফল্যগাথা বিনিময় করতে।
জানা গেছে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতৃত্বে অত্যন্ত দরিদ্র এই অঞ্চলের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি একটি আধুনিক অলৌকিক ঘটনা। নুজিয়াংয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় সিপিসি সদস্যরা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, স্থানীয়দের নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন এবং উদ্যোগী হতে উৎসাহিত করেছিলেন। চীন বৈশিষ্ট্যসহ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য একটি পদ্ধতি তৈরি করেছে। এটি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি উদহারণ হিসেবে কাজ করতে পারে।