
তুলসী গ্যাবার্ড
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। সরকারের উচিত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন না হওয়ার বাস্তব চিত্রটা মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা।
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার হীনচেষ্টার বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তার এ বক্তব্য দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও অভিমত তাদের।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাইনুল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, ভদ্রমহিলা একজন ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসেবে পরিচিত। তিনি আরএসএসে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশকেও পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র বানাতে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কড়া প্রতিবাদ জানানোর জন্য এ অবস্থা আর তৈরির সম্ভাবনা নেই। তবে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের প্রতি তীক্ষè নজর রেখেছে। যার প্রতিফলন গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে এসব জাতীয় ইস্যুতে দলমত, সুশীল সমাজকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক হয়ে দেশের জন্য লড়তে হবে। কোনো গ্যাপ বা দুর্বলতা পেলে বহির্বিশ্ব সেটাকে কাজে লাগাবে। সে বিষয় চিন্তায় রেখেই এসব সমস্যা ঐক্যবদ্ধভাবে সমাধান করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর) বিভাগের এমিরেটস অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়টাকে ভালো করে অ্যাড্রেস (নজর দেওয়া) করা দরকার। সমালোচনাটা বাড়তে থাকলে আদৌ ঠিক কি না, এভিডেন্স কোথায় এগুলো ভালো করে দেখা দরকার। যেহেতু একটা সমালোচনা আছে, এটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।
তিনি বলেন, যেসব সমালোচনা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর কারণ খুঁজে বাংলাদেশকেই সমাধানের কথা ভাবতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই সংখ্যালঘু ইস্যুতে বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। সেগুলোও তুলে ধরা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এটা নিয়ে একটা অ্যাটেনশন দিয়েছে, ফলে তার কী এভিডেন্স আছে, সেটাও দেখা দরকার। ফলে বাংলাদেশের সরকারকেই এখন দৃশ্যত তুলে ধরতে হবে যে, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তারা ভীতির মধ্যে নেই।
ড. ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, অন্যদেশে বসে বাংলাদেশের সম্পর্কে মন্তব্য করার গুরুত্ব খুব বেশি প্রভাব তৈরি করবে বলে মনে হয় না। তবে তার এ বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হতে পারে। তিনি গোয়েন্দা প্রধান হয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ডাটা কিছু না কিছু উনার কাছে একেবারে নেই সেটা ভাবার সুযোগ নেই।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, তুলসী গ্যাবার্ড গোয়েন্দা প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের মাইনোরিটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তো এবারই প্রথম এ মন্তব্য করেনি। এর আগে প্রিয়া সাহা নামে এক নারী মাইনোরিটি বিষয়ে জানতে চাইলে ডোনাল্ড ট্রাম্প একই কথা বলেছিলেন। সুতরাং এ বিষয়ে খুব বড় ধরনের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হবে বলে মনে হয় না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য বাংলাদেশকে চাপে রাখার একটি পলিসি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা পরিচালক ভারতে বসে যে বক্তব্য বাংলাদেশের মাইনোরিটি নিয়ে দিয়েছেন, সে বক্তব্যের সত্যতা যাছাই করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারেরও উচিত তার বাংলাদেশে আসার পরিবেশ তৈরি করা।
ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিনিয়র এ কূটনীতিক বলেন, তার এ বক্তব্যের পেছনে কিছু বাস্তবতা রয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামি স্টেটের (আইএস) কালো পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কালো মিছিল করেছে তো। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে সে মেসেজগুলো তার কাছে রয়েছে নিশ্চয়ই। তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য এগুলোকে কেন্দ্র করেও হতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না।
তিনি বলেন, ভারতের গণমাধ্যমগুলো এমনিতেই বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। সেদেশের একটি বেসরকারি মিডিয়ায় মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের সাক্ষাৎকারে কেন বাংলাদেশের ইস্যু টানা হয়েছে, সেটা নিতান্তই তার এবং ভারতের ব্যাপার। তবে একটা অভিযোগ উঠেছে, সে অভিযোগের বিষয়ে সরকারকেই বাস্তবতা বোঝাতে হবে।
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধানকে বাস্তব চিত্রটা উপলব্ধি করানো। তাহলে হয়তো তার এ ধারণা পরিবর্তন হতে পারে। তবে পরিবর্তন না হলেও বাংলাদেশের সরকারকে নীরবে কাজ করে বাস্তবতাকে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।
দেশের গণমাধ্যমগুলো যাতে এসব সংবাদ প্রচারে আরও দায়িত্বশীল হয়, সে ক্ষেত্রে সরকারের নজর বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেন তারা। সাবেক রাষ্ট্রদূত কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করছেন অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে তুলসী গ্যাবার্ড ওই মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে যথাযথভাবে হয়তো অবহিত নন। সে কারণে তিনি এ মন্তব্যটা করেছেন। কাজেই তাকে যদি আমরা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটা জানাতে পারি, তাহলে আমি মনে করি তিনি যেটা মনে করছেন সেটা হয়তো তার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।
তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখার অবকাশ নেই মন্তব্য করে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, সেজন্যই আমার ধারণা, বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই একটা প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে। এই বিবৃতির বাইরে বাংলাদেশের আর কোনো কিছু এখন আর করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
গ্যাবার্ড তার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্যাবিনেটের সদ্য দায়িত্ব নেওয়া সদস্যদের কথাবার্তা কেবল শুরু হয়েছেÑ এ বিষয়টি উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির জানান, এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমান বাস্তব অবস্থা তুলে ধরলে গ্যাবার্ডের অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থানে গ্যাবার্ডের মন্তব্য দেশটির অতীতের রেকর্ডকে অনুসরণ করে না বলে জানান তিনি। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যেভাবে জঙ্গি কর্মকা-, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান তৈরি করেছে, তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য যে মেলে না, সেটা জোরালোভাবে তুলে ধরা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
তুলসী গ্যাবার্ডের এই বক্তব্যকে একটা দেশের নীতি বলা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা বক্তব্য তো আর একটা নীতি হয় না, একটা বক্তব্য একটা অবস্থান হতে পারে। কাজেই সেই অবস্থানটা যে বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ নয়, সেটা আমাদের তুলে ধরতে হবে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এনডিটিভির সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন, হত্যা ও নির্যাতন দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সরকারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয় মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যদিও দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা ভারতের মুসলমানদের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যম। এমনিতেই ভারতে মুসলমানদের ওপর অনেক নির্যাতন চলছে। মুসলমানদের নির্যাতন বাড়িয়ে তাদের দেশ থেকে বের করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন তারা।