
মাহে রমজানের আজ ১৭তম দিবস
মাহে রমজানের আজ ১৭তম দিবস। ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটি এক বিশেষ কারণে স্মরণীয় ও বরণীয়। এদিন মাত্র তিনশ’ তেরোজন জিন্দাদিল মুসলমান সাহাবীর হাতে বদর প্রান্তরে প্রায় এক হাজার সুসজ্জিত অবিশ্বাসী সৈন্যবাহিনীর পরাজয় ঘটে। তাই রমজান আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি আত্মগৌরবেরও স্মৃতি বহন করে। এ যুদ্ধ মুসলমানদের প্রথম সামরিক বিজয়।
মাত্র তিনশ’ তেরোজন জিন্দাদিল মর্দে মুমিন সেদিন প্রতিপক্ষীয় এক হাজার দুশমন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে যে অলৌকিক বিজয় অর্জন করেছিলেন, তা জগতের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূচনা করে। এটি ছিল ২য় হিজরীর ঘটনা। হিজরতÑউত্তর মদীনায় ইসলামের ক্রমোন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং আবু সুফিয়ানের মিথ্যা রটনায় প্রলুব্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার দুরভিসন্ধিতে মক্কার কাফিররা এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। ফল হয়েছে তার উল্টো। বিজয় এসেছিল মুসলমানদের ঘরে।
ঘটনাটি ছিল এমন : কাফিরদের রণপ্রস্তুতিসহ মদীনাভিমুখে অগ্রসরমান অবস্থা জানতে পেরে আঁ-হযরত (স.) যুদ্ধসংক্রান্ত পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩মার্চ মোতাবেক ১৭ রমজান তারিখে ৩১৩ জনের একটি ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য প্রেরিত হয়। বদর উপত্যকায় দুই বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে।
হজরত মুহাম্মদ (স.) স্বয়ং য্দ্ধু পরিচালনা করে অনুপ্রেরণা দান করেন। আলÑআরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম শিবির স্থাপিত হয় এবং এর ফলে পানির কূপগুলো তাদের তত্ত্বাবধানে আসে। আল ওয়াকিদী বলেন, হজরত মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটা স্থান বেছে নেন, যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ শুরু হলে কোনো মুসলমান সৈন্যের চোখে সূর্যকিরণ বিঘœ ঘটাবে না।
প্রথমে প্রাচীন আরব রেওয়াজ অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয়। মহানবীর নির্দেশে হজরত আমীর হামজা, হজরত আলী ও আবু উবায়দা (রা.) কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা, শায়বা ও ওয়ালিদ বিন উতবার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে শত্রু পক্ষীয় নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয়।
উপায়ন্তর না দেখে আবু জেহেল বিধর্মী কুরাইশ বাহিনীসহ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মুসলমানদের প্রচ-ভাবে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু চরম প্রতিকূল অবস্থায় সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করা বিধর্মী কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অসামান্য রণÑনৈপুণ্য, অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলমানরা বদরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কাফিরদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এ যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হন এবং সমসংখ্যক বন্দি হয়। অপরদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাৎ বরণ করেন। কুখ্যাত আবু জেহেল এ যুদ্ধে নিহত হয়।
ইসলামের প্রথম সামরিক বিজয় বদর যুদ্ধের প্রতিটি দিক ও বিভাগই যেন উম্মতে মুসলিম এবং বিশ্ব সভ্যতার ভা-ারে একেকটি শিক্ষার স্বাক্ষর। সেদিন মহান পয়গাম্বরে খোদা (সা.) যুদ্ধবন্দিদের প্রতি যে উদার ও মধুর আচরণ করেছেন, তা সত্যিই প্রতীকী দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিক মুইর সেদিনকার এক যুদ্ধবন্দির জবানীতেই রাসূল ও তার সাহাবীদের মহানুভবতার বিবরণ দিয়েছেন : মদীনাবাসীদের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, তারা আমাদের উটে বা ঘোড়ায় চড়তে দিয়ে নিজেরা হেঁটে চলত।
তারা নিজেদের সামান্য রুটিও নিজেরা না খেয়ে আমাদের খেতে দিত, নিজেরা খোরমা খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত করত।’’ হজরত (স.) তাদের আহারÑবস্ত্রÑবাসস্থানের গ্যারান্টি দিলেন এবং মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্তি প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। উপরন্তু যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম, তাদের মুসলমানদের বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতিপূর্বক কিংবা মুসলমান শিশুÑকিশোরদের তালিম দেওয়ার অঙ্গীকারে মুক্তি দেওয়া হয়।
গত ১১ নভেম্বর’ ৯ পবিত্র হজ মৌসুমে মদীনা শরীফ জিয়ারতকালীন সময়ে আমি বদর যুদ্ধের এলাকা পরিদর্শন করি। এটি মদীনা শরীফ থেকে নতুন হাইওয়ে ধরে ১৬২ কিলোমিটার দূরে। এখানকার একটি সুন্দর মসজিদ ’জামে আরীশ’। মহানবী (স.) এ স্থানে দাঁড়িয়ে একটি উঁচু আসন থেকে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আরীশ অর্থ উঁচু মঞ্চ।
যেহেতু আঁ-হজরত এখানে অবস্থান করেছিলেন, তারই পুণ্যস্মৃতিস্বরূপ নির্মিত হয়েছে আরীশ মসজিদ। বর্তমানে এখানে নামায কালামের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয় এটি তত্ত্বাবধায়ন করে। আমাকে এ মসজিদে অভ্যর্থনা জানান ও সহযোগিতা করেন দুই বাঙালি ভাই আলী আজগর ও বাচ্চু মিয়া (বি. বাড়িয়া)। মসজিদের পেছনে রয়েছে সেই কূপ বা গর্ত, যেখানে নিহত কাফিরদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। নাম ’ বির-ই-আবু জেহেল’ ।
আমাদের গাইড বললেন, চলুন আরেকটা জিনিস দেখাই। ঐ যে পাহাড়, ঐ পাহাড়কে বলা হয় জাবালে মালাইকা। অর্থাৎ ফেরেশতাদের পাহাড়। আল্লাহ তায়ালা তার নবীজীকে ওয়াদা করেছিলেন বদর যুদ্ধে তিনি গায়েবী সাহায্য করবেন। এক হাজার জন সুদক্ষ কাফির সৈন্যবাহিনী মোকাবিলায় তিনশ’ তেরোজনের সঙ্গে অদৃশ্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করবেন। সত্যিই তিনি প্রেরণ করেছিলেন অসংখ্য ফেরেশতা যোদ্ধা।
এদের দেখেছিলেন মুসলিম ও অমুসলিম সৈন্যবাহিনী উভয় পক্ষ। সেদিন এরা যে পাহাড়ে অবতরণ করেছিলেন, সে পবিত্র পাহাড়টির নাম আজও জাবালে মালাইকা বা ফেরেশতা অবতরণের পাহাড় হিসেবে স্মরিত হয়ে থাকে।
বস্তুত, বদর যুদ্ধ ইতিহাসে এক যুগ প্রবর্তক ঘটনা। যে সমস্ত মুসলিম বীর জঙ্গে বদরে যুদ্ধ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তারা আরও অনেক বড় বড় যুদ্ধে অংশ নেন। অনেক দেশ জয় করেন। কিন্তু সেসব জয়Ñগৌরবকে কোনো মূল্য না দিয়ে বদর যুদ্ধে জড়িত থাকাকেই সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। ইরাকের শাসনকর্তা, কুফা নগরীর স্থপতি, পারস্য বিজয়ী মহাবীর সাদ অশীতিবর্ষ বয়সে মরণশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছিলেন, বদর যুদ্ধে পরিহিত বর্ম আমার পরিয়ে দাও, এই বেশে মরব বলে আমি এটি সযতেœ তুলে রেখেছি।’
বাস্তবিকই বদর যুদ্ধের গুরুত্ব ও গৌরব মিথ্যে নয়। এতদিন যে ইসলাম ছিল নিরীহ, এখন তা হলো নির্ভীক। এতদিন যা ছিল শান্ত সংযত, এখন সেটা হলো দুর্বার গতিশীল। তাই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বদর বিজয়ের দিনকে মুক্তির দিবস বলে অভিহিত করেছেন।