
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তেজগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে খুব বেশি সময় নেই। আমরা এরই মধ্যে সাত মাস পার করে এসেছি। আমরা বলছি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই এর মধ্যেই আমাদের যে সামর্থ্য আছে, যা যা সংস্কারের প্রয়োজন সেগুলো করতে হবে। সংস্কার করতে হবে এবং সেটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর যেহেতু নির্বাচন আসছে, নানা রকমের সমস্যা হবে, নানা রকম চাপ আসবে।
আমাদের সেখানে শক্ত থাকতে হবে, আইনের ভেতরে থাকতে হবে। যাতে করে যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে, সে সরকার আইনের সরকার হয়।’
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের উদ্দেশে করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আপনারাও সংস্কারের কথা বলেছেন। কারও জন্য অপেক্ষা করে কোনো ফায়দা হবে না।
কাজটা করতে হবে এবং সেটা আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দেশ বদলাতে হলে একক নির্দেশে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে এক একটি টিম হয়ে কাজ করতে হবে এবং বাংলাদেশে যত টিম আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিম হলো পুলিশ।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকার যা কিছুই করতে চায়, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত দিয়েই করতে হয়। তারা সব করে দেয় না, তারা পরিবশেটা সৃষ্টি করে। যে পরিবেশটা না থাকলে কোনো কাজই আর হয় না। পুলিশের কথা প্রসঙ্গে বারবার আমরা দুটো শব্দ বলছি আইন ও শৃঙ্খলা। পুলিশের হাতেই এটাকে এক্সিকিউট করতে হবে। এই পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে সরকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের অধিকার, নাগরিকের অধিকার কিছুই থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পুলিশকে অবহেলা করে দেশ গড়তে পারব না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই বাকি জিনিসগুলো হয়। আইনশৃঙ্খলা না থাকলে যত বড় বড় চিন্তাই হোক, যত টাকাই থাকুক, কোনো কাজে আসবে না।’
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ এবং রাজশাহী পুলিশ সুপার ফারজানা ইসলাম।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজ করতে পুলিশের অত্যন্ত বেগ পেতে হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এগুলো সমাধানের চেষ্টা করব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আমরা মস্ত বড় সুযোগ পেয়েছি। এটাকে যেন হারিয়ে না ফেলি। আমরাও সেটা চেষ্টা করব, ভবিষ্যতে যারা আসবে তারাও আশা করি চেষ্টা করবে। পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দেই।’
এই পথ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘পুলিশ বাহিনী একটা মস্ত বড় ভূমিকা’ পালন করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি। বলেন, ‘লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে আমরা এই যাত্রা শুরু করলাম। সারা দুনিয়ার যত দেশ আছে, সবাই আমাদের সমর্থন করল। শুধু মিনমিনে সমর্থন না। উৎসাহ ভরে এগিয়ে এলো। তারা মনে করেছে, এই দেশ উঠে দাঁড়াতে পারলে ভালো সঙ্গী হবে সবার। আমাদের ওপরে তারা ভরসা করে।’
একইভাবে নিজেদের ওপর ভরসা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর মুশকিল হলো, ওই অন্ধকার যুগে তারা একটিভ পার্টিসিপেন্ট ছিল নিজের ইচ্ছায় না, সরকারি কাজ করতে গিয়ে হয়েছে। কাজেই নতুন বাংলাদেশে পুলিশকে দেখিয়ে দিতে হবে আমরা মানুষ খারাপ না, খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিলাম, সেখান থেকে বের হয়ে এসেছি।
দেখো আমরা কি করতে পারি। কাজের মাধ্যমে আমরা দেখাব যে, আমাদের হাত দিয়েই এই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে। আমরা বড় রকম ভূমিকা পালন করব। কারণ আমাদের কাছেই রয়েছে আইন ও শৃঙ্খলা এটা প্রতিষ্ঠা করব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পুলিশ হবে বন্ধু। কারণ, আমি আইনের পক্ষের মানুষ। আমি আইন প্রতিষ্ঠা করার মানুষ। আইন হলো আমাদের সবার আশ্রয়। পুলিশ হলো আশ্রয়দাতা। আমরা এই ইমেজটা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, মানুষ অতীতের সব কথা ভুলে যাবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘১৬ বছরের ইতিহাস আমরা বদলাতে পারব না। ১৬ বছরের কালিমা সারা গায়ে মাখা আছে, রাতারাতি সেটা পাল্টাতে পারব না। একজন মানুষ হিসেবে আমি কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারি, সম্পূর্ণ নতুন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি। নতুন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী হিসেবে আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। অতীত নিয়ে কান্নাকাটির দরকার নেই। নতুনের জন্য আমরা প্রস্তুত এবং এটা করে দেখাব।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ সম্বন্ধে ইমেজ হলো, তারা খারাপটাই আগে দেখে, খারাপটা আগে করে। কিন্তু আমরা ভালোটা আগে দেখব, ভালোটা আগে করব। দু-একজন করাপ্ট হলে বাহিনী পাল্টায় না। বাহিনী সামগ্রিকভাবে একটা কাঠামো এবং এই কাঠামোর অনেক শক্তি।’
পুলিশকে নতুন শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মানুষকে বাধা দেবো না। তার পথকে সহজ করব। তার পাশে থাকব। তাহলে দেখব যে, এ দেশের কোনো সমস্যা হবে না। শুধু মানুষের পাশে থেকে তাদের আইনের ভেতরে রাখতে হবে। তাকে বলতে হবে, আইনের ভেতরে থাকেন, আপনার যা দরকার আমি করে দেব।’
নির্বাচনের সময় পুলিশকে শক্ত থাকতে হবে ॥ নির্বাচন আসন্ন উল্লেখ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যেহেতু নির্বাচন আসছে, নানা রকমের সমস্যা হবে, নানা রকম চাপ আসবে। অনেকে ডেসপারেট হয়ে যাবে আমার কেন্দ্রে জেতাতে হবে, ওর কেন্দ্রে জেতাতে হবে। সেখানে পুলিশ আইন মানতে চাইলে তারা ক্ষ্যাপাক্ষেপি করবে।
আমাদের সেখানে শক্ত থাকতে হবে, আইনের ভেতরে থাকতে হবে। যাতে করে যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে, সে সরকার আইনের সরকার হয়। যে আইন ভেঙে আসবে, সে কখনো আইন ধরে রাখতে পারবে না। কারণ, আইন ভাঙাই তার অভ্যাস।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা যেন আইনের সরকার হয়। আইন ভেঙে যে আসবে সেই সরকার কোনোদিন আইন রাখতে পারবে না। কারণ তার ভাঙারই অভ্যাস। কাজেই এই সুযোগটা এমন যে ভবিষ্যতের সরকার যেন আইন মানার সরকার হয়।
সেটারও দায়িত্ব তোমাদের হাতে, যেহেতু নির্বাচন তোমাদের (পুলিশ) হাত দিয়ে হবে। কারও কথা মানার দরকার নাই। আইন যা বলে তুমি আইনের ভেতরে থাক। আমাদের শুধু ভয় হলো আবার যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যাই। ছাত্ররা আমাদের রক্ষা করেছে, আবার যেন আমরা সেই গর্তে ঢুকে না যাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। ৮ আগস্টের পর আমরা ভুলে গেছি যে, যুদ্ধ নাই, শেষ। কথা ঠিক না। আমরা একটা অনবরত যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। এটা যেন মনে থাকে। এই যুদ্ধাবস্থা থেকে আমাদের জয়ী হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। লোকে সুযোগ গ্রহণ করে, যারা পরাজিত শক্তি তারা সুযোগ গ্রহণ করে একটা কিছু উস্কিয়ে দেবে, গোলমাল পাকিয়ে দেবে।
এটা প্রথমেই আসবে পুলিশের নজরে। তার (পরাজিত শক্তি) চেষ্টাই হবে গোলযোগ পাকিয়ে দেওয়া। কারণ সে তো সম্মুখ যুদ্ধে আসতে পারছে না। এখানেও সম্মুখে থাকবে পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতি নজরে রাখা এবং খেয়াল রাখা। তার মানে এই নয় যে, কাউকে সন্দেহের বশে কারাগারে নেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধাবস্থা ক্রমাগত ঘনীভূত হবে। কালো মেঘ থেকে ঘূর্ণিঝড় হতে থাকবে। আমরা সতর্ক থাকলে এটা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ নেই। নিত্যনতুনভাবে অপপ্রচার হবে। অপপ্রচারের একটা কারখানা আছে। তোমাদেরও দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেবে, কাজেই সতর্ক থাকতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন উঠিয়ে দেওয়ার পর অনেকেই বলা শুরু করল রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। আমরা বলেছি যে, রোহিঙ্গাদের তো ডাটাবেজ ইউএনএইচসিআর’র কাছে আছে। বায়োমেট্রিক চেক করলেই বুঝে যাবে যে, এটা তো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। কারণ এই দুটো ডাটাবেজ কানেক্টেড হয়ে যাবে। তাহলে সেখানে আর সেই সুযোগ থাকবে না। পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষই ঠিক করবে কাজটা। কাজেই এখানে পুলিশ ভেরিফিকেশনের দরকার নেই, যেহেতু প্রযুক্তি আমাদের সাহায্য করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকদিনের মধ্যে স্টারলিংক চালু হয়ে যাবে। শুরু হয়ে গেলে দেখবেন ইন্টারনেটের গতি কেমন। এত দ্রুত গতির ইন্টারনেট আগে ছিল না। তাতে সব কিছু হাতের মুঠোয় চলে আসবে।’
নারীদের সুরক্ষা দিতে হবে ॥ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নারীদের আমাদের সুরক্ষা দিতে হবে। এটা অনেক বড় কাজ। আমাদের অবহেলার কারণে সমাজে এটা দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের দেশের অর্ধেক মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার কেউ নাই।
রাস্তাঘাটে চলতে ভয় পায়। এটা কোনো ধরনের কথা! তাদের নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের আইনি দায়িত্ব। নিজ নিজ এলাকায় সেটি করতে হবে। কোথাও যেন কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে বহু সম্ভাবনার এই দেশ এখানেই শেষ হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ একটি মস্ত বড় সম্ভাবনার দেশ মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে এটা অনুভব করি। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে আনতে পারছি না, ঠেকে যাচ্ছে। আজকে আমরা সুযোগ পেয়েছি, মস্ত বড় সুযোগ- সেই সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করা। তাই আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি, শৃঙ্খলা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে যেকোনো যুদ্ধ জয় সম্ভব।
তিনি বলেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার যে যুদ্ধ-লড়াই, এটা আনন্দের লড়াই, কষ্টের কোনো লড়াই না। যতই এগিয়ে যায়, তত ফুর্তি লাগে। নিজেদের কাছেও ফুর্তি লাগে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে ফুর্তি লাগে। আমরা একটা কাজ করছি, তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। নিজের তৃপ্তি হচ্ছে, আমি এমন একটা ভূমিকায় আছি, যে ভূমিকায় দেশের একটা পরিবর্তন হবে। নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে আমরা এখানে বড় একটা ভূমিকা পালন করব, কারণ আমাদের কাছে আছে আইন এবং শৃঙ্খলা। এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পরিবেশটা সৃষ্টি হয়, যেখান থেকে দেশ উড়াল দেবে।’