
রায় ঘোষণার পর রবিবার কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আবরারের ভাই, বাবা ও পরিবারের সদস্যরা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদন্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ রবিবার এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে বি রুমি, জহিরুল ইসলাম সুমন, নূর মোহাম্মদ আজমী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার সুমাইয়া আজিজ উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে আইনজীবী মাসুদ হাসান চৌধুরী, আজিজুর রহমান দুলু উপস্থিত ছিলেন। আদালতকক্ষে আবরার ফাহাদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
হাইকোর্টের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আবরার ফাহাদের পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করে। অন্যদিকে আসামি পক্ষ বলেছেন, তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় পাননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। এর আগে রবিবার বেলা ১১টায় আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের রায় ঘোষণা শুরু হয়। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রায় ঘোষণা শুরু হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান রায় পাঠ করে শোনান।
মৃত্যুদ-ে দ-িতরা হলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)। যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত ৫ জন হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থণা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষ হয়। তার আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপাপ্তদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়। গত বছরের অক্টোবর মাসে এ মামলার মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ উদ্যোগ নেন।
২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। এরপর আসামিরা দন্ড থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। দন্ডতরা উচ্চ আদালতে ফৌজদারি আপিল এবং জেল আপিল করতে পারেন।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদন্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দেন। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরদিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। মাত্র ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার দায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। এ মামলায় আরও পাঁচ শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়।
জাতি ন্যায় বিচার পেয়েছে ॥ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদলতের রায় হাইকোর্টে থাকায় জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। দুপুরে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আবরার ফাহাদের মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনে থাই পাহাড়ের মতো ভারি হয়ে আছে।
এ ধরনের রায়ের মধ্যদিয়ে একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ডিসিপ্লিন আনার জন্য এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের প্রতি যে ধারণা, সে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো। তিনি বলেন, আজকের রায়ের মধ্যদিয়ে সমাজে এই বার্তা গেল যে আপনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, আপনার পিছে যত শক্তিই থাকুক না কেন, সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ন্যায়বিচার হবেই।
বুয়েট ছাত্র আবরারের মৃত্যু প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মাও সে তুংয়ের মতো বলতে হয়, কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারি। কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা। আবরার ফাহাদের মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনে থাই পাহাড়ের মতো ভারি হয়ে আছে। আবরার ফাহাদের মৃত্যু গোটা জাতির মূল্যবোধের শেকড়ে নাড়া দিয়েছে।
আসাদুজ্জামান বলেন, আবরার ফাহাদের মৃত্যু এটাই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে যে ফ্যাসিজম যত শক্তিশালীই হোক মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কখনো কখনো জেগে উঠে সব ফ্যাসিজমকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে দিতে পারে।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ২০ জনের ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন বহাল রয়েছে উচ্চ আদালতে। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত চার আসামি পলাতক রয়েছেন। উচ্চ আদালতে আদেশ বহাল থাকায় গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। ‘আপনি যত শক্তিশালী হোন না কেন পেছনে যেই থাকুক না কেন, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
রায়ে সন্তুষ্টি ॥ হাইকোর্টের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে আমি সন্তুষ্ট। এখন সব প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত রায় কার্যকর দেখতে চাই।’ রবিবার রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন তিনি।
স্টেপগুলো দ্রুত শেষ হোক ॥ এদিকে বড় ভাই আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ছোট ভাই বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমরা সাড়ে পাঁচ বছর ধরে এটা নিয়ে আছি। আরও কত দিন লাগবে আমরা জানি না। তবে এটা যত দ্রুত শেষ হবে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা না ঘটে। তাই আমাদের চাওয়া, বাকি যে স্টেপগুলো আছে তা দ্রুত শেষ করা’।
ন্যায় বিচার পাইনি ॥ উচ্চ আদালতের এ রায়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী ন্যায় বিচার পাননি বলে দাবি করেছেন দুই আসামির আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। হাইকোর্টের রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা জানান। তিনি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম ও মেফতাউল ইসলাম জিওনের পক্ষের আইনজীবী।
প্রতিক্রিয়ায় আজিজুর রহমান দুলু বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় যে রায় পড়ে শোনানো হয়েছে, তাতে সংশ্লিষ্ট ট্রায়াল ট্রাইব্যুনালের রায় আগের মতোই বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট ডিভিশন। রবিবার প্রদত্ত রায়ে আমি আইনজীবী হিসেবে সংক্ষুব্ধ এবং আমি মনে করি ন্যায়বিচার যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা ন্যায়বিচার পাইনি।
কেন আপনি সংক্ষুব্ধ এই প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, আমি যাদের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলাম, তার মধ্যে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের নাম এজাহারে ছিল না। তার বিরুদ্ধে যে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সাজা দেওয়া হয়েছিল ট্রায়াল ট্রাইব্যুনালে সেই চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য, অর্থাৎ তাদের জবানবন্দিতে সেই বক্তব্যগুলো নেই। ট্রায়াল ট্রাইব্যুনাল অস্তিত্বহীন ডিপোজিশন ইনসার্ট করে রায় দিয়েছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে একটিও ইনক্রিবিডিং এভিডেন্স নেই। এই কারণে আমি মনে করছি যে, ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি। আশাকরি আপিল বিভাগ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর পরই আমরা আপিল বিভাগে আপিল করব।