
.
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সংকেত পেলে তফসিল ঘোষণা করবে। তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। ইতোমধ্যেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রবাসীরাও বিশেষ ব্যবস্থায় ভোট দিতে পারবে। কোনো কেন্দ্রে ইভিএম নয়, এবার সব কেন্দ্রে ভোট হবে ব্যালট পেপারে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নানামুখী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ইসি। নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোও মাঠে সক্রিয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ বছর ডিসেম্বরে অথবা ২০২৬ সালের মধ্যভাগে নির্বাচনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বেশ ক’টি সুপারিশ করে। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে ভোট কখন হবে সে বিষয়ে জনমনে সংশয় থাকলেও প্রধান প্রধান দল বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ নিজ কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে।
বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন দাবি করেছে। জামায়াত বলছে, আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, আগে সংবিধানসহ সকল সংস্কার কাজ শেষ করে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কার শেষে যথাসময়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবদুর রহমানেল মাসুদ, তহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ক’দিন পর পর নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকও করেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কি কি প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে সেদিকে নজর দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বিদেশী কূটনীতিকসহ অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন তারা। উল্লেখ্য, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এই কমিশন সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করে। সেই সঙ্গে কমিশন গঠনের পর নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মাচরীরা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে বেঈমানি হবে। এত রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। জীবনে কোনোদিন আমি ফেল করিনি। আশা করি এবারও ফেল করব না। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে সিইসি বলেন, সব বড় বড় দল সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছে। আশা করি, তারা তাদের কথা রাখবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুত। আমরা স্বাধীন ও ষোলোআনা নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করব। এবার এমন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে যা অতীতে কখনো হয়নি। তবে সবাইকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনী ট্রেনের হুইসেল প্রধান উপদেষ্টা বাজিয়ে দিয়েছেন। এবার কোনো কেন্দ্রে ইভিএমে নয়, সব কেন্দ্রে ভোট হবে ব্যালটে। ডিসেম্বরে টার্গেট রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডিসেম্বরে ভোট করতে হলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। আমরা যাতে ওই টাইমলাইনটা মিস না করি সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে তিন মাস পর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোচ্চার হয় তখন অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। সরকারের একজন উপদেষ্টা নির্বাচনের টাইমলাইন সম্পর্কে ধারণা দেওয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ইতিবাচকভাবে নেয়। তবে বিএনপি ও তাদের সমমনা ক’টি দলের পক্ষ থেকে প্রথমে দাবি করা হয় আগামী জুনের মধ্যে ও পরে আগস্টের মধ্যে। এ পরিস্থিতিতে গত বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৬-এর মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে। এর পর বিএনপি থেকে বলা হয় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে সেটি ধরে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের কাজ চলমান রয়েছে। নির্বাচন সামগ্রী ক্রয়ের কাজও শীঘ্রই শেষ করা হবে বলে জানা যায়।
এদিকে ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগর সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন। প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও গণসংযোগ জোরদার করছেন। বিএনপি এবার ৩০০ আসনের মধ্যে কিছু আসন সমমনা দলগুলোকে ছেড়ে দেবে বলে জানিয়েছে। এছাড়াও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইও শুরু করে দিয়েছে।
জামায়াত সারাদেশে নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করেছে। ৩০০ আসনে নির্বাচনের কথা বলে ইতোমধ্যেই অনেক আসনে প্রার্থীও ঘোষণা করে ফেলেছে জামায়াত। আলোচিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। তারাও ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়। এছাড়াও আরও বেশকিছু দল নিজেদের মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়।
সূত্র মতে, নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এবার ইসি প্রবাসীদের ভোটার করার বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক মাসের মাথায় ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সিইসি ছাড়াও পদত্যাগ করা অন্য কমিশনাররা হলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আহসান হাবীব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা, মোহাম্মদ আলমগীর এবং আনিছুর রহমান। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওই নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ওই নির্বাচন কমিশন পদত্যাগের পর ২১ নভেম্বর এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর দেশের নির্বাচনী মাঠ এখন বিএনপির অনুকূলে। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন এই পরিবেশ থাকতে থাকতেই যেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে- এমন আশা থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচন চান। আর ভোটের আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ নিষ্কণ্টক রাখতে দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতা এখন সারাদেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা সভা-সমাবেশে নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে জনসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করছেন। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করে সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করছেন। আবার জনগণের মন জয় করে ক্ষমতায় যেতে জামায়াতও বিরামহীনভাবে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। নতুন দল এনসিপিও নির্বাচনমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠের দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে।
এদিকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে কঠোর নজরদারি রেখেছে। এরই অংশ অংশ হিসেবে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, চীন, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ঢাকায় কর্মরত মিশন প্রধানরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও তাদের জানানো হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে। আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেনি এমন ১৯ মুসলিম দেশের মিশন প্রধানদেরও ডেকেছে ইসি। আজ ১৭ মার্চ তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন সিইসিসহ ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আজ ১৭ মার্চ যে ১৯ দেশের মিশন প্রধানদের সঙ্গে ইসি মতবিনিময় করবে তারা হচ্ছে- মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম, মালদ্বীপ ও মরক্কো।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ২ মার্চ দেশে ভোটার ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। এর পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ভোটার সংগ্রহ ও মৃত ভোটার বাদ দেওয়া শেষে হালনাগাদ তালিকায় যুক্ত হয় আরও ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ ভোটার। এ ছাড়া রিভাইজিং অথরিটির যাচাই-বাছাইয়ে যোগ হয় আরও ৪৮ হাজার ৭৬২ জন। সবমিলিয়ে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৬১ হাজার ৬১৫ পুরুষ। নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৫ এবং হিজড়া ভোটার সংখ্যা ৯৯৪ জন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেসব বিষয় জরুরি প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে- নির্ভুল ভোটার তালিকা, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ইসি। আর কিছু কাজ নির্বাচনের আগে আগে করতে হয়, সেগুলোও যথাসময়ে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতির শেষ ধাপে রয়েছে। জুনের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য সকল কার্যক্রম শেষ করবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে তফসিল ঘোষণা করে দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে ইসি।