ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়লেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে

​​​​​​​এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০১:১৫, ১৫ মার্চ ২০২৫

ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়লেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে

.

নিত্যপণ্যের বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। পাইকারি বাজারে কমেছে সয়াবিন পামঅয়েলের দাম। তবে খুচরা বাজারে এখনো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের ভোজ্যতেল। দাম কমার প্রভাব খুচরায় না পড়ায় ভোক্তাদের এখনো বেশি দাম দিয়ে তেল কিনতে হচ্ছে। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অবৈধভাবে মজুতকৃত ভোজ্যতেল উদ্ধার করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুত রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইতোমধ্যে খুচরা বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংকটের মধ্যে বাজারে বোতলজাত   খোলা ভোজ্যতেলের সরবরাহ বেড়েছে। সুপারশপের পাশাপাশি বিভিন্ন মুদিদোকানে এক লিটার, পাঁচ লিটার এবং আট লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। তবে বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি এবং বিভিন্ন বাজারে এখনো তেল পাওয়া যাচ্ছে সীমিত পরিসরে। ফলে বাজারে সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও খুচরা বাজারে আগের দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। তবে পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের কাছে এখন ভোজ্যতেলের আর কোনো সংকট নেই। মিলগুলো থেকে চাহিদা মতো ভোজ্যতেলের সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে পাইকারি বাজারে প্রতিলিটারে খোলা তেলের দাম কমেছে ১৮-২০ টাকা পর্যন্ত।

ঢাকার কাওরান বাজার, ফকিরাপুল বাজার, কাপ্তান বাজার, সেগুনবাগিচা, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর এবং মানিকনগরের মতো বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, তীর, রূপচাঁদা, ফ্রেশ বসুন্ধরা সয়াবিন তেলের সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। যদিও আগের মতো সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। অন্যদিকে উল্টোচিত্র পাইকারি বাজারে। সেখানে ভোজ্যতেলের কোনো সংকট নেই। প্রসঙ্গে ঢাকার মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ী বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, মিলগেট থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ফলে পাইকারি বাজার থেকে যে কেউ চাহিদামতো ভোজ্যতেল কিনতে পারবেন। তিনি জানান, পাইকারিতে প্রতি লিটার সয়াবিন পামঅয়েলের প্রায় ১৮-২০ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। শীঘ্রই খুচরা বাজারেও দাম কমার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এদিকে, মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিলগেট ডেলিভারিতে প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১৫১ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে যা পাইকারি মার্কেট থেকে ১৫৩ টাকা দিয়ে নিতে পারছেন খুচরা বিক্রেতারা। পামঅয়েল মিলগেটে ১৪০ দশমিক ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও পাইকারিতে ১৪৩ টাকা এবং সুপার পামঅয়েল মিলগেটে ১৪৭ টাকা এবং পাইকারিতে ১৪৯ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল মানভেদে এখনো ১৮৫-১৯০ টাকা লিটার পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা সরকারের নির্ধারিত ১৫৮ টাকার চেয়ে বেশি। এছাড়া পাঁচ লিটারের প্রতিটি ক্যান ৯৫০-১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। খুচরা বাজারে দাম না কমায় সাধারণ ক্রেতারা সমস্যায় পড়ছেন। অনেকেই দাম বাড়ার জন্য বিক্রেতাদের দুষছেন। এদিকে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকটের মুখে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। হাতেগোনা কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন  (বিটিটিসি) থেকেও ইতোমধ্যে কৃত্রিম সংকটের কথা জানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের মুখে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে  অবৈধভাবে রাখা মজুদকৃত তেল ধরা পড়ছে।

একদিকে অভিযান, অন্যদিকে মিলগুলো থেকে সরবরাহ বাড়ায় ভোজ্যতেলের বাজার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।  প্রসঙ্গে খিলগাঁও গোড়ার বাজারের বাজারের বিক্রেতা জাকির হোসেন টিটু  জনকণ্ঠকে বলেন, আগে তেল পাওয়া যেত না, তবে এখন আমরা তীর বসুন্ধরাসহ কয়েকটি  ব্র্যান্ডের তেল পাচ্ছি। তবে চাহিদা অনুযায়ী এখনো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, পাঁচ কার্টনের চাহিদা থাকলেও কোম্পানি দুই কার্টন তেল পাঠাচ্ছে এবং ঈদের আগে হয়তো সরবরাহ কিছুটা স্বাভাবিক হবে। এদিকে ভোজ্যতেলের বাজার স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীনের। সম্প্রতি তিনি ঢাকার কাওরান বাজার মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটসহ কয়েকটি বাজার পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি জানান, শীঘ্রই বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ছাড়া রোজার শুরুতে তিনি দাম কমার বিষয়ে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে বাজার এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তবে বাজার অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সাড়ে হাজার লিটার সয়াবিন তেল মজুত করে রাখায় টিকে গ্রুপের একজন ডিলারকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তথ্য ছিল দোকানের  ভেতরে মজুত করে রাখা হয়েছে ৪২৩ কার্টন ( হাজার ৭০০ লিটার) বোতলজাত সয়াবিন। পাশাপাশি তিন শতাধিক কার্টন পাম তেলও রাখা হয়েছে। অভিযানে গিয়ে এমন তথ্যের সত্যতা পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তৎক্ষণাৎ এসব তেল জব্দ করে পাইকারি দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

এর আগে রোজার শুরুতে রাজধানীর কাওরান বাজারের কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ২০০ কার্টনের বেশি বোতলজাত সয়াবিন তেল উদ্ধার করে অধিদপ্তর। বিক্রেতারা এসব তেল গোপনীয় স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এছাড়া শান্তিনগর বাজার কাওরান বাজারে অভিযানকালে সাতটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল মজুত করে রাখার প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিদপ্তর। প্রায় প্রতিটি অভিযানেই অবৈধভাবে মজুদকৃত তেল বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তিতে ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, অভিযানে তারা দেখেছে যে বেশ কিছু দোকানের সহজে দৃশ্যমান স্থানে  ভোজ্যতেল প্রদর্শন করা হচ্ছে না এবং ক্রেতাদের তেল নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে তল্লাশিতে  দোকানের গোপনীয় স্থানে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলের ( লিটারের ২০০ কার্টনের বেশি) মজুত পাওয়া যায়। ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট নেই। কিছু পাইকারি খুচরা অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা লাভের আশায় তেল লুকিয়ে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছেন। রমজান সামনে রেখে তারা এমনটা করেছেন। সে জন্য তদারক কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার সম্প্রতি এক বৈঠক শেষে বলেন, কেউ অবৈধ মজুতের সুযোগ নিতে পারবে না। বাজারে আমদানি এবং সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। কিন্তু ভোজ্যতেল নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছুটা অস্বস্তি আছে। তবে যতটুকু আছে সেটি নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

বিপুল পরিমাণ আমদানি, সংকট কৃত্রিম বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন নৌঘাটে সয়াবিন সিড বোঝাই ৫৬টি ব্যক্তি মালিকানাধীন লাইটার জাহাজ খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এখানে এমনও জাহাজ রয়েছে, যেগুলো থেকে প্রায় এক মাসেও পণ্য খালাস করেনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। ফলে চলতি রমজানে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের (বিডব্লিউটিসিসি) তথ্য অনুযায়ী, এসব লাইটার জাহাজে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন সিড রয়েছে। জাহাজগুলো দেশের বিভিন্ন নদীবন্দরে নোঙর করেছে। তবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় সরবরাহ সংকট তৈরি হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, এভাবে খালাস আটকে রাখার ফলে ভোজ্যতেল উৎপাদনের কাঁচামালের সংকট ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে, যার ফলে বাজারে দামও বেড়েছে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) অভিযোগ করেছে, কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জাহাজগুলোকে ভাসমান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, লাইটার জাহাজে এভাবে সয়াবিন সিড ফেলে রাখার ফলে বাজারে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি এর পেছনে সিন্ডিকেট রয়েছে অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়, এর প্রায় সবকটির দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহন খরচ কমেছে। দেশে ডলারের সরবরাহ ভালো। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উল্টো আরও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সার্বিকভাবে ভোজ্যতেলে দাম নি¤œমুখী। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ছাড়া কর ভ্যাটের সুবিধা নিয়ে আমদানি বাড়লেও সেই তেলের অবৈধ মজুত বাড়ানো হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে সয়াবিন তেলের মাসিক চাহিদা দেড় লাখ থেকে লাখ ৬০ হাজার টন। সেখানে জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছে লাখ ৭২ হাজার টন। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে লাখ ১৭ হাজার টন। গত ছয় বছরের মধ্যে এক মাসের হিসাবে এটিই সর্বোচ্চ আমদানি। আবার একই সময়ে সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিনবীজ আমদানিও ছিল ৩১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমদানি হওয়া এই তেল প্রক্রিয়াজাত শেষে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে বাজারে থাকার কথা। কিন্তু জানুয়ারির বিপুল আমদানির পরও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এনবিআরের হিসাবে, অপরিশোধিত সয়াবিন ছাড়াও জানুয়ারিতে সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন। ২০২২ সালের জুনের পর এই আমদানিও ছিল সর্বোচ্চ।

×