
সৈয়দ মঞ্জর এলাহী
চামড়া শিল্পের দিকপাল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জর এলাহী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। বুধবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর পাশে ছিলেন ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও মেয়ে মুনিজে মঞ্জুর। এর আগে ২০২০ সালের ২৬ মে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী ও সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবিরের মায়ের চাচা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। আলমাস কবির বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত কারণে জনাব এলাহীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কমে এসেছিল। প্রথমে ফুসফুসের সংক্রমণ কাটিয়ে উঠলেও, পরবর্তীতে পাকস্থলীর সংক্রমণ হয়।’
এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জানাজা হবে আজ বৃহস্পতিবার বাদ জোহর। গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে বনানী কবরস্থানে।
১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্ম নেওয়া মঞ্জুর এলাহী কলকাতাঁর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই বহুজাতিক কোম্পানি পাকিস্তান টোব্যাকোতে (বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো) চাকরি পান। করাচিতে শুরু করেন কর্মজীবন। ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বদলি হন ঢাকায়। মাঝে কয়েক মাসের জন্য কর্মস্থল ছিল বিলেত। তাঁরপরও অভিজাত নিশ্চিত জীবন ছেড়ে বেছে নিলেন দুর্গন্ধময় হাজারীবাগ। দামি গাড়ি ছেড়ে উঠলেন রিক্সায়। চামড়ার ভাঁজে খুঁজে নিলেন নতুন এক অধ্যায়।
১৯৭২ সালে তিনি মঞ্জুর ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে কমিশনের ভিত্তিতে চামড়া বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। চার বছর পর তিনি ১২ লাখ ২২ হাজার টাকায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে অ্যাপেক্স ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪ বছর পর তাঁর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। বর্তমানে এটি দেশের শীর্ষ জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
৪৯ বছর আগে বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হওয়া সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী এখন চামড়া খাতের একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়ার জুতাঁর রপ্তানি শুরু হয়। রপ্তানির পাশাপাশি দেশের জুতাঁর বাজারেও অন্যতম শীর্ষস্থান দখল করেছে তাঁর প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স। যদিও ছোটবেলায় বাবা-ভাইদের যখন বড় হয়ে ব্যবসায়ী হওয়ার কথা বলতেন, তখন হেসেই উড়িয়ে দিতেন। বলতেন, ‘তুই ব্যবসার কী বুঝিস। আমাদের চৌদ্দ পুরুষে কেউ ব্যবসায়ী নাই।’
অবশ্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে শুধু সফল ব্যবসায়ীর গ-ির মধ্যে রাখলে ভুল হবে। তিনি ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তখন যোগাযোগ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালেও ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। তাঁর বাইরে সংগঠক হিসেবেও অনেক কাজ করেছেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও তিনি।
বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, প্রধান উপদেষ্টা এক শোকবার্তায় বলেছেন, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বাংলাদেশের উদ্যোক্তা জগতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ছিলেন। দেশের চামড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর একান্ত পরিশ্রমে এপেক্স ফুটওয়্যার দেশের শীর্ষস্থানীয় জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
দায়িত্ব পালনকালে তাঁর দক্ষতার প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, সংগঠক হিসেবেও তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে। তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা জগতে সবার শ্রদ্ধাভাজন, দেশপ্রেমিক শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মৃত্যুতে আমি গভীর শোক জানাই। আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি।
বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি মহাসচিব বুধবার এক শোকবার্তায় বলেন, ‘সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী সফল শিল্প উদ্যোক্তা, দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি হিসেবে সমাজে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমি শোকাভিভূত। তাঁর মতো গুণী ব্যক্তির শূন্যতা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমি তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি, যেন তাঁরা শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন।’
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। এক শোক বার্তায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মৃত্যুতে বসুন্ধরা গ্রুপ ও আমার পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি।
তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার বিরাট উৎস হয়ে থাকবে। আমি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং দোয়া করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও গভীর শোক ও সমবেদনা জানান বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।
তাঁর মৃত্যুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এ সময় তিনি বলেন, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী দেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এবং সফল ব্যবসায়িক নেতা ছিলেন। শিল্প ও বাণিজ্য, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তাঁকে এদেশের ব্যবসায়িক সমাজ, তরুণ উদ্যোক্তা তথা সাধারণ জনগণ সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মনোনীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে পুঁজিবাজার উন্নয়নে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং গ্রে অ্যাডভারটাইজিং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স (এএমসিএইচএএম), বাংলাদেশ থেকে ২০০০ সালে ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার’ এবং ২০০২ সালে ‘বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৯৬ সালে যোগাযোগ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল; পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০০১ সালে কৃষি, নৌপরিবহন, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।