ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল, তার স্ত্রী-মেয়েও আসামি

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় অনিয়মে ১২ এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৩০, ১২ মার্চ ২০২৫

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় অনিয়মে ১২ এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় অনিয়ম

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় অনিয়মের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের রিক্রুটিং এজেন্সিসহ ১২ এজেন্সির বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে সামিট গ্রুপের রাজধানীর বাড্ডায় ৫৪ কাঠা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া স্ত্রীসহ বাহাউদ্দিনের ফ্ল্যাট জব্দ, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান।
সংস্থাটির মহাপরিচালক জানান, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া ও পাচারের দায়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালের রিক্রুটিং এজেন্সিসহ ১২ এজেন্সির বিরুদ্ধে পৃথক ১২টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। আসামির তালিকায় রয়েছে ১২ রিক্রুটিং এজেন্সির ৩২ মালিক-কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার স্থলে অতিরিক্ত পাঁচগুণ অর্থ গ্রহণ করে ৬৭ হাজার ৩৮০ জন প্রবাসী থেকে ওই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক জানায়, ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মেসার্স ওরবিটাল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে ছয় হাজার ২৯ প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমিরি কামাল। মামলায় কাশমিরির পাশাপাশি মুস্তফা কামালও আসামি।
মেসার্স ওরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে দুই হাজার ৯৯৫ জন থেকে অতিরিক্ত ৫০ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল। এ মামলায় বাবা ও মেয়ে আসামি।
স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেডের মাধ্যমে ছয় হাজার ৬৫৭ জন প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১১১ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম, শেখ আব্দুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, এম আমিরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও মো. জিয়াউর রহমান ভুঁইয়া।
রিক্রুটিং এজেন্সি বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে পাঁচ হাজার ৪৫৮ জনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৯১ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক চৌদ্দগ্রামের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ভুঁইয়া, তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে আসামি করা হয়েছে।
ফাইভএম ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সাত হাজার ১২৪ জনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১১৯ কোটি ৩২ লাখ ৭০ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত, মেহবুবা আফতাব সাথি, মাসুদ উদ্দিনের মেয়ে তাসনিয়া মাসুদ আসামি।
মেসার্স ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে তিন হাজার ৭৮৮ জন থেকে ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহা. নুর আলী, তার স্ত্রী সেলিনা আলী, মেয়ে নাবিলা আলী, নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব খোন্দকার শওকত হোসেনকে আসামি করা হয়েছে।
ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মাধ্যমে সাত হাজার ৭৮৭ জন থেকে ১৩০ কোটি ৪৩ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং তার স্ত্রী লুৎফুন নেছা শেলী আসামি।
মেসার্স আহমদ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে আট হাজার ৫৯২ জন প্রবাসীর কাছ থেকে ১৪৩ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদ আসামি।
বিএম ট্রাভেলস লিমিটেডের মাধ্যমে আট হাজার ৯৩ জন প্রবাসীর কাছ থেকে ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে আসামি হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী মৌসুমি আক্তার।
বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেডের মাধ্যমে চার হাজার ২১৫ জন প্রবাসী থেকে ৭০ কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক যুবলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ সৈকত ও তার স্ত্রী নসরুন নেছাকে আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে রুবেল বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে দুই হাজার ৮৪৫ জনের কাছ থেকে ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মুহাম্মদ মজিবুল হক রুবেল ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার হীরামনি আসামি হয়েছে।
এ ছাড়া দ্য ইফতী ওভারসীজের মাধ্যমে তিন হাজার ৭৯৭ জন প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ৬৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. রুবেল ও বোরহান উদ্দিন পান্নাকে আসামি করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেক প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত এক লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়েছে ধরে হিসাব করা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি)/১৬১/১৬২/১৬৩/১৬৪/১৬৫(ক)/৪২০/৪০৯/১০৯ ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ফি বাবদ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান।
সামিট গ্রুপের ৫৪ কাঠা জমি জব্দ ॥ গোপালগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফারুক খানের ভাই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার পরিবার ও তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের নামে থাকা রাজধানীর বাড্ডা এলাকার ৫৪ কাঠা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। যার বাজার মূল্য এক কোটি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য ৯ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আক্তারুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, দুদকের উপপরিচালক আলমগীর হোসেন এ আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, সামিট গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগসহ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য একটি যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে গোপন সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মালিকানাধীন স্থাবর সম্পদ হস্তান্তর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এজন্য তার মালিকানাধীন স্থাবর সম্পদ জব্দ করা প্রয়োজন। এরআগে গত ৯ মার্চ সামিট গ্রুপের ১৯১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত। এসব হিসাবে ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬০ টাকা রয়েছে।
স্ত্রীসহ বাহাউদ্দিনের ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব জব্দ ॥ কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেছার নামে ঢাকার উত্তরায় থাকা দুইটি ফ্ল্যাট এবং তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা চারটি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এসব ব্যাংক হিসাবে ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৬৭ টাকা জমা রয়েছে। মঙ্গলবার দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন। এদিন এসব স্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ চেয়ে আবেদন করেন দুদক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৭ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগদখলে রাখার দায়ে দুদক একটি মামলা করে। মামলাটি তদন্তকালে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি তার নামীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অন্যত্র হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার প্রচেষ্টা করছেন। মামলা নিষ্পত্তির পূর্বে নিম্নবর্ণিত সম্পত্তি হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে সমূহ ক্ষতির কারণ রয়েছে। এজন্য উল্লিখিত স্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া প্রয়োজন।

×