
রহমত প্রাপ্তির মাস রমজানুল মুবারকের ১০টি সিয়াম অতিবাহিত
দেখতে দেখতে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত প্রাপ্তির মাস রমজানুল মুবারকের ১০টি সিয়াম অতিবাহিত হয়ে গেল। আগামীকাল থেকে শুরু হবে মাগফিরাতের প্রতিশ্রুত মাঝের দশক। এ মাস আমাদের সুপরিবর্তনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করুক।
বর্তমান সমাজে ‘চেতনা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যে কোনো ব্যাপারে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক কার্যপরিসরে মৃতপ্রায় ও উদাসীন এ সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা ‘চেতনা’র প্রয়োগ করি। কিন্তু একটি বিশেষ চেতনা জাগরূক করতে পারলে আমাদের হাজার অচেতন অবস্থা কেটে উঠত।
মানুষ ধনের প্রতিযোগিতা, মানের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো না, অবতীর্ণ হতো সত্যনিষ্ঠ ও আমানতদার প্রমাণের প্রতিযোগিতায়। কীভাবে সততার সঙ্গে অল্প তুষ্ট থেকে জীবন কাটানো যায় তা খুঁজে বের করত সচেতন মানুষ। ফলে লাভ হতো যে, প্রতিযোগিতার বাজারে দুর্বল শ্রেণি মাঠে মারা যেত না, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার লোভ ও স্বার্থে মানুষ যা-তা করার সাহস পেত না। মাস্তান কমত, দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজ দুটোই নিপাত যেত।
লোকেরা আপনাতে আপনি মগ্ন হতো, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে সমাজ সুন্দরে অবদান রাখত। সে বিশেষ চেতনাটি হলো আখেরাতের ভয় বা পরকালীন চেতনা। মনে মনে এ হিসাবটা বার বার করে দেখা যায় যে, আমার সুনির্দিষ্ট এ দুনিয়াবী জীবনের পরে বহুত কষ্টার্জিত ধনসম্পদগুলো আমার সঙ্গে থাকছে কিনা।
বস্তুত: দেখা যায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ থেকে নগণ্য ফকির পর্যন্ত জন্মকালীন সময়ে যে অসহায় অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়, ঠিক একই অসহায় ও নিঃস্ব বদনে ভূগর্ভে (মাটির নিচে) চলে যেতে হয়। সেই চেতনা শক্তির অভাবে বণী আদম আজ পথভ্রষ্ট, দিকভ্রান্ত। ধন-বৈভবের প্রতিযোগিতায় এখন মানুষ না পারছে নিজের জন্য চিন্তা করতে আর না পারছে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। মানব জীবনের এ এক বড় ত্রুটি বড় বোকামি বৈ কিছু নয়। অনেক আগের একটি কাহিনী আজও সমাজের বিভিন্ন মুরুব্বি শ্রেণির মুখে শোনা যায়।
কোনো এক বাদশাহ তাঁর বাঁদীকে খুব ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসার উপহার স্বরূপ তিনি বাঁদীকে একটি শাহী ক্ষমতাদান করলেন। ক্ষমতাটি হলো- যদি তুমি কোনো বোকা লোক পাও তবে তার মুখে থু থু নিক্ষেপ করবে। এরপর থেকে থু থু খাওয়ার ভয়ে শাহী মহলে সবাই চিন্তাভাবনা করে চলতে লাগল। এমনকি শিক্ষিত প-িতরাও বেশ সতর্ক। বাঁদী কোথাও বোকা লোক পেল না যার মুখে থু থু ফেলা যায়। একদিন বাদশাহ কঠিন অসুখে-। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সবাইকে ডেকে ডেকে আখেরি বিদায় নিচ্ছেন। বাঁদীকেও ডেকে বিদায় চাচ্ছেন তিনি।
বাদশাহ বলছেনÑ ‘বাঁদী আমি চললাম।’ বাঁদী বাদশাহ নামদার, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ উত্তরে বাদশাহ: ‘আমি এমন জায়গায় যাচ্ছি যেখান থেকে কেউ কোনো দিন ফিরে আসে না।’ বাঁদী: ‘বাদশাহ সালামত! আপনার সঙ্গে সেবা কার্যের বাঁদী, লোকজন, বিছানাপত্র, সৈন্য সামন্ত, তখত ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে?’ বাদশাহ বললেন: ‘না বাঁদী! ওখানে দাসদাসী, সৈন্য সামন্ত, লোকজন, বিছানাপত্র কিছুই নেওয়া যায় না।
তবে যে জিনিসের বিনিময়ে এগুলোর চেয়ে বেশি দামি বিছানাপত্র, সেবিকা, আরাম আয়েশ পাওয়া যায় আমি তো আর কিছুই সংগ্রহ করিনি বাঁদী। আমি যে আজ রিক্তহস্ত। এতকিছু থেকেও আজ শূন্যহাতে আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে বাঁদী। আমি জীবনে এত বোকামি করেছি। আজ আমি বুঝতে পেরেছি আমার মতো বোকা আর একটি নেই।’
বাঁদী: ‘বাদশা মহান! আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি আমাকে থু থু নিক্ষেপের ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। আমি এত দিন তেমন কোনো বোকা লোক না পেয়ে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারিনি। আজ আমি বুঝতে পারছি আপনি সেই বোকা। এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আরাম আয়েশের জন্য আপনার যা দরকার এ সবই আপনি করেছেন; বরং অনেক বাড়িয়ে করেছেন।
দাসী দরকার একজন, করেছেন হাজার জন। হাতি-ঘোড়া, দালান-কোটা সব করেছেন। অথচ চিরকাল যেখানে থাকতে হবে সেখানকার জন্য আপনি কিছুই করেননি। তাই আপনি সে বোকা শ্রেষ্ঠ- যার মুখে এই অধম বাঁদী থু থু নিক্ষেপ করতে পারে!’
কুরআনে এসেছে: ‘ওয়া তাজাওয়াদু ফাঈন্না খাইরাজ্জাদিত্ তাকওয়া অর্থাৎ হে মানুষেরা! তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করে নাও তবে মনে রেখো যে, তাকওয়াই হলো উত্তম পাথেয়।’ তাকওয়া মানেই হলো পরকালীন জবাবদিহিতার মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে হালাল হারাম বাছবিচার করে চলা। আসলে দুনিয়ার বুকে খুব নগণ্য পরিমাণ মানুষই পরকালকে অস্বীকার করে।
অপর পক্ষে প্রায় সকলেই আখেরাতকে মানুষের অবধারিত চিরস্থায়ী মঞ্জিল হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু সমস্যা হলো কাজের মাঝে এ বিশ্বাস সংরক্ষণ করে না। এতেই বিপত্তি। আখেরাতের জন্য তো বটেই, দুনিয়ার সুখ-সৌন্দর্যের জন্যও চাই পরকালীন সচেতনতা সর্বক্ষণ।