
রাজনীতির মাঠে আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী
হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী। একের পর এক রাজনৈতিক ভূমিকায় নজর কাড়ছে দলটি। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগের আগেই চব্বিশের শহীদ পরিবারকে অর্থ সহযোগিতা, আহতদের চিকিৎসা এবং দক্ষিণাঞ্চলে বন্যায় ভূমিকা পালন করা দলটিকে নিয়ে সর্বমহলে চলছে আলোচনা। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ভোটের মাঠে নামছে দলটি।
অতীতে বিএনপিসহ অনেকের সঙ্গে জোটে নির্বাচন করলেও এবার দলটি অগ্রসর হচ্ছে একলা চলা নীতি নিয়ে। আবার রাজনৈতিক কৌশলগত জোটের সুযোগও রাখা হয়েছে। দেশজুড়ে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি জানান দেওয়া হচ্ছে। নানা কর্মসূচি ও নানা উদ্যোগে জনপ্রিয়তা প্রমাণের চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে দলটি। একইভাবে ড. ইউনূস সরকারের ওপরও চাপ অব্যাহত রেখেছে যাতে খুব শীঘ্রই নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।
অতীতে জোটের সিদ্ধান্তে ভোটের মাঠে লড়াই করলেও এবার দলটি জনপ্রিয়তার হিসাব মাথায় রেখে দেশের সব আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তত ২৫০টি আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে। প্রার্থীরা এখন থেকেই ভোটের মাঠে কর্মসূচির মাধ্যমে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
দিনক্ষণ ঠিক না থকলেও নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত সাড়ে পনেরো বছরেরও বেশি সময় কঠিন সময় পার করেছে দলটি। দলটির একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো ও কারাগারে রাখা হয়। সর্বশষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাঝে নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে।
সব বাধা পেরিয়ে একদিকে দল গোছানো অপর দিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার বিষয়টি এখন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। দ্রুতই দলের নিবন্ধন এবং প্রতীক ফিরে পাওয়ার আসা নেতাদের। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা দাবি করে আসছেন, প্রথমে ছাত্র-জনতার হত্যার বিচার এবং সংস্কার শেষে নির্বাচন। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে জামায়াত।
নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারা সাংগঠনিক সফর করছেন সারাদেশে। যুবক ও তরুণদের নিয়ে সারাদেশে চলছে চালানো হচ্ছে সামাজিক কার্যক্রম। আলেম ওলামাদের সমন্বয়ে চলছে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম এবং মাহফিল। নারী ভোটারদের টানতে মহিলা জামায়াতের কার্যক্রম চলছে প্রতিটি সাংগঠিনক ইউনিট থেকে মহানগর পর্যন্ত।
কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্যরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী একটি আদর্শিক গণতান্ত্রিক দল। আমরা সবসময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। নির্বাচনের সময় নির্ধারণ না হলেও আমরা প্রতিটি জেলায় প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাই করছি। নির্বাচন মাথায় রেখে দলীয় প্রার্থী তালিকা করা হচ্ছে। জোট এবং অন্যান্য পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয়ভাবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হবে।
সাংগঠনিক জেলাও বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫০টি আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে বাছাই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
নির্বাচনী আবহ তৈরি হওয়ার আগেই নিবন্ধন এবং প্রতীক ফিরে পাওয়ার জন্য আইনি লড়াই করছে জামায়াত। এখন পর্যন্ত পতিত সরকারের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্ত ছিল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহার করা হয়।
ফলে ‘দাঁড়িপাল্লা’ অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচার তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পাশাপাশি যদি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা হলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে বছর-মাস কিংবা দিন কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট করে দেইনি। আমরা চাই, চব্বিশের আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের বিচার করে তারপর নির্বাচন। দ্রুত নির্বাচন আমরাও চাই। তবে সেটা অবাধ নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সেটার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন।
আর এ জন্য দরকার ইলেকশন, জুডিসিয়াল, সংবিধান, পুলিশসহ ৬-৭টি জায়গায় সংস্কার। এটা না করলে নির্বাচন ১৪, ১৮ ও ২৪-এর মতোই হবে। আমরা ১৫ বছর অপেক্ষা করেছি। দুই এক মাস আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কি না। আমরা একটা দাবি করেছি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। এটি না হলে পেশি শক্তি ও কালো টাকার খেলা চলবে। এ ছাড়া দলীয় প্রভাব এর ওপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখবে।
সংসদীয় আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকার বিষয়ে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, জামায়াত একটি নির্বাচনমুখী দল। ৩০০ আসনে নির্বাচন করার জন্য আমরা মাঠ এবং প্রার্থী প্রস্তুত করার কাজে মাঠে নেমেছি। এখন বিভিন্ন জেলায় আসনভিত্তিক যে প্রার্থী করা হচ্ছে তা প্রাথমিক বাছাই তালিকা। চূড়ান্ত তালিকা কেন্দ্র থেকে আরও পরে ঘোষণা হবে।
জোট গঠনের বিষয়ে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে কোনো দলের সঙ্গেই জোটবদ্ধ হতে পারে জামায়াত। সেখানে ইসলামী দল কিংবা নতুন রাজনৈতিক দলগুলো থাকতে পারে। সেটা হতে পারে পাঁচ কিংবা দশ দলের জোট।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর চলছে। এখনো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো দেশে বৈষম্য শেষ হয়নি। এই বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্রে ইসলামী আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের ঐক্য। আগামী নির্বাচনে ইসলামিক দলগুলোকে এক জোটে আনার কাজ চলছে। আগামী নির্বাচনে ইসলামী জনতার ব্যালট বাক্স হবে একটি। আমরা যদি এটি বাস্তবায়ন করতে পারি এই বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দলের নিবন্ধন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগীয় সম্পাদক ও দলের মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ দলের নিবন্ধন পেয়েছিল। এ কারণে যখন ফের নিবন্ধন ফিরে পাবে তখন দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহই পাবে। এর ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই।
যেসব আসনে প্রাথমিক প্রার্থী দিয়েছে জামায়াত ॥ এখন পর্যন্ত ৩০০ আসনের মধ্যে ২৪৯টি আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। যার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭০টি আসনের মধ্যে ৫৩টি। চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪৯টি। সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে সব ক’টি। ময়মনসিংহ বিভাগের ২৪টি আসনের মধ্যে ১৯টি।
বরিশাল বিভাগে ২১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৯টি। খুলনা বিভাগের ৩৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩২টি। রাজশাহী বিভাগে ৩৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩৫টি। রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের মধ্যে ২৪টি আসনে জামায়াত প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে।