ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৭ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১

রাঘব-বোয়ালদের ধরবো; প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তির বিচার হবে : তাজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ৭ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ০০:৪৭, ৭ মার্চ ২০২৫

রাঘব-বোয়ালদের ধরবো; প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তির বিচার হবে : তাজুল ইসলাম

ছবি : সংগৃহীত

আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর মো: তাজুল ইসলাম বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যে বিচারের কাজগুলো করছে, সেখানে দু ধরনের বিচারের জন্য আমরা কাজ করছি। একটা হচ্ছে জুলাই আগস্টে সংগঠিত যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, এই যে আপরাইজিং, এই যে বাংলা বসন্ত, সেই সময়ে আমাদের বীর সন্তানদের উপরে যে পৈশাচিক আক্রমণ চালানো হয়েছে, যারা এটার আর্কিটেক্ট ছিল, যারা মাস্টারমাইন্ড ছিল এবং গ্রাউন্ড লেভেলে যারা আইন লঙ্ঘন করে, অতি উৎসাহী হয়ে, শুধুমাত্র শেখ হাসিনা বা উর্ধ্বতনদের নেক নজরে পড়ার জন্য, যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল, সেই সমস্ত সকল রাঘববোয়ালকে আমরা ধরবো।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের সভা কক্ষে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের উপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ বিষয়ক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের টার্গেট হচ্ছে সত্যিকারের পারপিট্রেটর, গোটা পুলিশ বাহিনী নয়। সেজন্য আপনারা দেখবেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে মোট ৫০ এর সামান্য বেশি সংখ্যক পুলিশ অফিসারকে আমরা আসামি করেছি। অথচ বাংলাদেশে ২০০০ এর বেশি মানুষকে খুন করা হয়েছে। এর সাথে হাজার হাজার পুলিশ বাহিনীর সদস্য জড়িত ছিল। ২৫ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। অ্যাট্রোসিটির কি মাত্রা আপনারা কল্পনা করতে পারেন, আপনারা নিজের চোখে দেখেছেন।

আমরা কিন্তু হাজার হাজার পুলিশকে ধরছি না। এটার মেসেজ এটাই, যে বাকিদেরকে ঢালাও ভাবে আমরা শিকারে পরিণত করবো না। আমাদের টার্গেট কনস্টেবল পর্যায়ের পুলিশ নয়, আমরা প্রধান হুকুমদাতা, মাস্টারমাইন্ড, সুপেরিয়র, রেসপন্সিবিলিটি যার আছে, শেখ হাসিনা, আমরা তাকে ধরবো।

চীফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা তার পরবর্তী ক্যাবিনেটে যারা ছিল, তাদেরকে ধরতে চাই। এবং তারা যে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন, আপনাদেরকে আমি আশ্বস্ত করে বলতে চাই, তার সমস্ত তথ্য প্রমাণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থার হাতে আছে। তারা মানুষকে সার্ভেলেন্সে রাখার জন্য, গুম করার জন্য তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে পেছন থেকে মনিটর করে তাদের উপর কিভাবে নিপীড়ন চালানোর যায়, সেজন্য নানা ধরনের মেকানিজম তারা বাংলাদেশে তৈরি করে রেখেছিল।

নিষিদ্ধ ঘোষিত যে পেগাসাস প্রযুক্তি, সেই প্রযুক্তি ইন্টারন্যাশনালি কিন্তু এটা ব্যান, সেই নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রযুক্তি বাংলাদেশে শত কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে এসে, সেই প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী, সাধারণ মানুষের পেছনে সারভেলেন্স করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের উপরে সার্ভেলেন্স করা হয়েছে। যারা অপিনিয়ন মেক করেন সমাজের, সমাজকর্মী-মানবাধিকার কর্মী তাদের পেছনে সারভেলেন্স করা হয়েছে। তাদেরকে ধরার কাজে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। তাদেরকে ধরে অনেককে মারা হয়েছে। ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। আয়নাঘরে বন্দি করা হয়েছে।

চীফ প্রসিকিউটর মো: তাজুল ইসলাম বলেন, আয়নাঘরের ব্যাপারে আপনাদের কিছু তথ্য শেয়ার করতে চাই। টিএফআই সেল নামে যে আয়নাঘরটি আছে ঢাকায়, বাংলাদেশে আপনাদের শুধু ঢাকা নিয়ে ভাববেন না, প্রত্যেকটা জায়গায়, জেলায় এই ধরনের আয়নাঘরের সন্ধান আমরা পেয়েছি। সেই টিএফআই সেলে একজন ব্যক্তির কথা বলব, যিনি একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, একজন ব্যারিস্টার, তাকে সাড়ে আট বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটা রুমে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টা তাকে চোখ বন্ধ করে বেঁধে রাখা হতো। দিনের বেলায় সামনে হাত হাতকরা পড়িয়ে রাখা হতো। রাতের বেলা ঘুমের সময় তাকে পেছনে হাতকরা পড়িয়ে রাখা হতো। এইভাবে আলো-বাতাসহীন একটা রুমে, যে রুমের কোন ভেন্টিলেশন নাই, কোন ফ্যান নাই, কোন লাইট ছিল না।

পরবর্তীতে তাকে একটা লাইট দেয়া হয় এজন্য যে, রাতের বেলায় সে কি করছে এটা মনিটর করার জন্য। বাইরে থেকে একটা ছোট্ট ছিদ্র ছিল, সেইটা দিয়ে তাকে যাতে বুঝা যায় সেটার জন্য একটা লাইট লাগানো হয়েছিল। আপনি কল্পনা করেন, এরকম একটা রুমে যদি সাড়ে আট বছর আপনাকে বন্দি রাখা হয়, আপনি বেঁচে থাকবেন!

এর মধ্যে সে অসুস্থ হয়েছে, সার্জারির প্রয়োজন হয়েছে, ওই রুমেই তাকে কোন ধরনের ডাক্তার এনেছে জানিনা, সেখানে ডেকেই তাকে সার্জারি করা হয়েছে। পাশের রুমগুলোতে ছিল টর্চার সেল। সারারাত ধরে পৈশাচিক করা হতো। সেই টর্চারের মাত্রা ছিল যে, তাদেরকে পায়ে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলানো হতো। যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। দেয়ালে বিভৎস ছবি টানিয়ে রেখে দেখানো হতো, তোর অবস্থা এরকম হবে।

তাজুল ইসলাম বলেন, একটা ছেলের খবর আমরা পেয়েছি, যাকে এত নির্যাতন করা হয়েছিল সারা শলীল পচে গিয়েছিল। পাশের রুমের বন্দীরা বলতো, যে এখানে অনেক দুর্গন্ধ হয় কেন। তো তখন এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে বারবার ফ্রেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তীতে জানা গেছে, যে বন্দি ফিরে এসেছে সে বলেছে, তাকে এত নির্যাতন করা হয়েছিল ঘা হয়ে গিয়েছিল। তার ঘায়ের দুর্গন্ধে পুরো সেলের মধ্যে বাকিরা এই দুর্গন্ধটা টের পেত। তারপরে একদিন সে মারা যায়।

পাশের সেলে নির্যাতন করতে করতে মানুষ যখন মারা গিয়েছে, অন্য পাশের রুমের বন্দীদেরকে ডেকে নিয়ে ওই রুমের লাইট অফ করে, লাইট তো অফই থাকে, ডেড বডির উপর দিয়ে হাঁটানো হতো। এবং বলা হতো টের পাশ কিছু, তোর অবস্থা এরকম হবে, যা বলবো তা করবি। এইটা ছিল আয়না ঘরের চিত্র।

আয়নাঘরের ৩ ফুট বাই ৬ ফুট সেলের মধ্যে ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের সাংবাদিককে নিয়ে আমি প্রবেশ করে আমি বললাম, তুমি এখানে দুই মিনিট দরজা বন্ধ করে থাকো। কারণ কোন ভেন্টিলেশন নাই, একটা স্টিলের দরজা আছে, সেখানে ছোট্ট একটা ছিদ্র আছে, ওইটা আবার মুরগির খোপের মতো বন্ধ করে দেয়া যায়। ওকে বন্ধ করে দিয়ে ক্যামেরায় এনে বললাম, তুমি থাকো দুইটা মিনিট। ১০ মিনিটের কথা বলেছিলাম, দেড় মিনিটের মাথায় সে হাঁপাতে হাঁপাতে বের হয়ে এসে বলল, সো ক্লাস্ট্রোফোবিক। ইম্পসিবল টু স্টে হেয়ার।

তাজুল ইসলাম আরো বলেন, এগুলো গোটা দুনিয়ার কাছে মানুষ বন্দিত্ব থেকে ফিরে এসে অনেকে বলেছে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি। আমরা যখন এগুলো উদ্ঘাটন করতে শুরু করলাম, প্রধান উপদেষ্টা দেখতে গেলেন, গোটা দুনিয়ার গণমাধ্যমে এগুলো আসতে শুরু করল, জাতি বুঝতে পারলো যে, আসলে কি আচরণ করা হয়েছে।

১৫ বছরে শাসনের নামে বাংলাদেশে কি পৈশাচিকতার স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল, এই আয়নাঘরের বাংলাদেশে বাংলাদেশকে আর ফিরে যেতে দেয়া যাবে না। আমরা যদি সেটা ফিরে যেতে এলাও করি, তাহলে আমাদের শহীদ সন্তানদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে।

আমাদের আবু সাঈদ, মুগ্ধের রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে, নিরাপদ ভবিষ্যৎ তাদের জন্য রেখে যেতে চাই। যে বাংলাদেশে আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ বোধ না করে, তাদের মেধা থাকার কারণে ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনা করার নামে চলে গিয়ে, সেখানে সেটেল করা আর কখনো বাংলাদেশে ফেরত আসতে না চাওয়ার যে কালচার বাংলাদেশে হয়ে গেছে, আমরা বাংলাদেশকে সেই দিন থেকে মুক্ত করে আনতে চাই।

আমাদের সন্তানেরা যেন নির্বিঘ্নে বাংলাদেশকে তার পরবর্তী গন্তব্য ভাবতে পারে, তারা যেন বুঝতে পারে তাদের মেধা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন এই রাষ্ট্রে হবে, যেই রাষ্ট্র তাদের পূর্বপুরুষেরা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছিল, তাদের সহকর্মীরা দ্বিতীয়বার এটাকে স্বাধীন করেছে।এই রাষ্ট্রকে আবার সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে না, যেদিন বাংলাদেশের ভিন্ন মত পোষণকারী মানুষদেরকে দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হবে।

মো. মহিউদ্দিন

×