
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার নতুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন মেরুকরণের রাজনীতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ক্রমপরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে দুই শীর্ষ নেতার।
বহুল কাক্সিক্ষত এই বৈঠকে গুরুত্ব পেতে পারে চীনের প্রেসিডেন্টের তিন বৈশ্বিক উদ্যোগ- গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ। দুই দেশই চলতি বৈঠককে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
এই সফরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এবারের সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে বেজিংয়ে বৈঠক হবে। এছাড়া বিওএও ফোরাম ফর এশিয়া কনফারেন্সে বক্তব্য রাখবেন প্রধান উপদেষ্টা।
উল্লেখ্য, চীনের হাইনান প্রদেশে ২৫-২৮ মার্চ অনুষ্ঠেয় একটি কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরবর্তীতে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পরে বিওএও ফোরাম কনফারেন্সে প্রধান উপদেষ্টা যোগ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উভয়পক্ষ রাজি হলে এবারের সফরে একাধিক চুক্তি সই হতে পারে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
গত জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন চীন সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের সফরের বিষয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া বছরজুড়ে দুই দেশ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। এছাড়া দেশটির বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশের প্রতি। এবারের সফরে বিনিয়োগ সম্পর্ক গুরুত্ব পেতে পারে।
কূটনীতিতে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। আজকে যে দেশ বন্ধুভাবাপন্ন বা কম বন্ধুভাবাপন্ন, কাল হয়ত স্বার্থ বা অন্য কারণে দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। যেমন ২০২৪-এর ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে ভারত। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কিছুটা কম উষ্ণ।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা অস্বস্তিকর এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল চমৎকার এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে ইউনূস সরকার। ইতোমধ্যে ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইলন মাস্কের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মাত্রা ও গভীরতা নির্ভর করে ঢাকার জাতীয় স্বার্থ এবং ওইসব দেশের আগ্রহের ওপর। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নশীল কর্মকা-ে আগ্রহ দেখাচ্ছে চীন। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। উভয়ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং নেবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি কেনা বা ইলন মাস্কের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের আগেও বাংলাদেশীদের ভিসা প্রদানে কোনো সমস্যা ছিল না ভারতের। বছরে ১৫ লাখের বেশি ভিসা ইস্যু করা হতো। এর একটি বড় অংশ ছিল মেডিক্যাল ভিসা এবং সেটিও এখন অনেক সংকুচিত। তিনি বলেন, ভারতীয়রা কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটির ব্যাখ্যা তারাই দিতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশীরা তাদের মতো করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে এবং নিচ্ছে।
ভিসা ইস্যুর মাধ্যমে একটি দেশ আরেকটি দেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে। এর বড় উদাহরণ ভারত। বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশ পর্যটক ছাড়াও চিকিৎসার জন্য ভারতে যেত এবং কূটনীতিতে এটি প্রভাব বিস্তারকারী বড় একটি উপাদান। বর্তমানে ভারতীয় ভিসা সংকুচিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছে চীন এবং বাংলাদেশ থেকে মেডিক্যাল টুরিস্টের প্রথম দলটি আগামী ১০ মার্চ চীনের কুনমিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
এ বিষয়ে আরেক সাবেক কূটনীতিক বলেন, নতুন বাস্তবতার আলোকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার ধরন পরিবর্তন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ চীনকে অনুরোধ করছে বাংলাদেশীদের চিকিৎসার জন্য কুনমিংয়ে তিনটি হাসপাতাল নির্ধারিত করে দেওয়ার জন্য এবং বেজিং সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছে। চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর বাংলাদেশীরা সন্তুষ্ট হলে সেখানে আরও মেডিক্যাল ট্যুরিজম বাড়বে এবং এর ফলাফল হিসেবে কোমল শক্তির বহির্প্রকাশ হিসেবে চীনের প্রভাব বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে তিনি জানান।