
বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেবে। অবশ্য তিনি এও বলেন, নির্বাচনে কে অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎকারটি দেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা সামিরা হুসেইন। সাক্ষাৎকারটি বৃহস্পতিবার বিবিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিতে বলা হলে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
শান্তিতে নোবেল জয়ী ইউনূস বলেন, আমার ধারণা ছিল না যে আমি সরকারের নেতৃত্ব দেব। আমি আগে কখনো সরকার চালাইনি। অথচ আমাকেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাপারটি যখন ঠিক হয়ে গেল তখন আমরা কাজগুলো সংঘটিত করতে শুরু করি। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, দেশের জন্য অর্থনীতি ঠিক করা আমাদের অগ্রাধিকার ছিল।
মুহাম্মদ ইউনূস চলতি বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজনের আশা করছেন। ভারতে থাকা শেখ হাসিনা ও তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তাদের (আওয়ামী লীগকে) সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা এটা করতে চায় কি না। আমি তাদের হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাচনে কে অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এবং অর্থনীতিও। এটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া অর্থনীতি, একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতি। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটা এমন যেন ১৬ বছর ধরে কিছু ভয়ঙ্কর টর্নেডো বয়ে গেছে। এবং আমরা টুকরোগুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি কঠোরভাবে বাংলাদেশ শাসন করেন।
তার আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যরা নির্মমভাবে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালান। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা ও জেলে পাঠানোর ব্যাপক অভিযোগ ছিল। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে গত আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। আন্দোলনকারীদের অনুরোধে মুহাম্মদ ইউনূস নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তিনি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবেন। বিষয়টি নির্ভর করবে তার সরকার কত দ্রুত সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে পারে, সেটার ওপর। তিনি মনে করেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ সংস্কার প্রয়োজনীয়। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যদি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত সংস্কার করা যায়, তাহলে ডিসেম্বরে আমরা নির্বাচন করতে পারব। আপনার যদি সংস্কারের দীর্ঘ সংস্করণ থাকে, তাহলে আমাদের আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
গত গ্রীষ্মে বাংলাদেশে হওয়া সহিংস বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা থেকে এসেছি। তখন মানুষকে গুলি করা হচ্ছিল, হত্যা করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রায় সাত মাস চললেও ঢাকার মানুষ বলছেন, আইনশৃঙ্খলা এখনো পুনরুদ্ধার হয়নি। পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে না।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ভালো একটি আপেক্ষিক শব্দ। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে তা ঠিক আছে। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখন যা ঘটছে, তা অন্য সময়ের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য আগের সরকারকে দায়ী করেন মুহাম্মদ ইউনূস। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এসব জিনিস ঘটুক, তা আমি সমর্থন করছি না। আমি বলছি, আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, আমরা একটি আদর্শ দেশ বা একটি আদর্শ শহর নই, যা আমরা হঠাৎ করে তৈরি করেছি। এটা আমাদের দেশের একটি ধারাবাহিকতা, যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। বহু বছর ধরে দেশের এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে।
শেখ হাসিনার নৃশংস শাসনের শিকার মানুষ এখনো ক্ষুব্ধ। ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের জন্য তার বিচার দাবিতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাজারো বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমেছেন।
বাংলাদেশের একটি আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু ভারত এখনো কোনো জবাব দেয়নি। এখন মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ হাসিনার প্রয়াত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়, আগুন দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা ইউটিউবে বক্তব্য দেবেন বলে তার সমর্থকদের বলার পর এসব ঘটনা ঘটে।
অন্তর্বর্তী সরকার সহিংসতাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ তাদের জন্য নিরাপদ নয় বলে আওয়ামী লীগের সদস্যদের দাবির বিষয়ে বিবিসি জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারের সমর্থনে কথা বলেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশে আদালত আছে, আইন আছে, থানা আছে। তারা গিয়ে অভিযোগ করতে পারেন। মামলা করতে পারেন।
ইউনূস বলেন, আপনি অভিযোগ করার জন্য শুধু বিবিসির সংবাদদাতার কাছে যাবেন না। আপনি অভিযোগ করতে থানায় যান। দেখুন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে কি না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের বিদেশী সহায়তায় কাটছাঁট এবং মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) অর্থায়নের প্রায় সব কর্মসূচি কার্যকরভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মতো দেশে প্রভাব ফেলবে।
এ বিষয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সিদ্ধান্ত। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটি উপকারী ছিল। কারণ, তারা এমন কিছু করে এসেছে, যা আমরা করতে চেয়েছিলাম। যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো বিষয়, যা সঠিকভাবে করার সামর্থ্য এখনো আমাদের হয়নি। বাংলাদেশকে উন্নয়নসহায়তা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তৃতীয়।
যুক্তরাষ্ট্র গত বছর বাংলাদেশকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে, জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যখন এটা ঘটবে, আমরা তা পূরণ করব।