ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৭ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১

সংসদ নির্বাচনের পথে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ৬ মার্চ ২০২৫

সংসদ নির্বাচনের পথে বিএনপি

পুরোদমে নির্বাচনের পথে বিএনপি

পুরোদমে নির্বাচনের পথে বিএনপি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে নানামুখী কৌশল নিয়ে সক্রিয় রয়েছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে দলটি এখন সকল কর্মসূচি পালন করছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এদিকে আগেই প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য তিনজন করে প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে দলীয় হাইকমান্ড।

তবে ৩০০ আসনের জন্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে গিয়ে বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রস্তাব তুলে ধরবেন। লিখিত একটি ড্রাফট তুলে দেবে ওই কমিশনের কাছে। 
জানা যায়, কোনো অবস্থাতেই আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। এজন্যই তারা অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে গিয়েও আগে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তাব দেবে দলটি। বিএনপির দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি বিএনপির বর্ধিত সভায় সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাদের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার বার্তা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এখন হতে কেন্দ্র থেকে দলের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে সফল করতে হবে। 
সারাদেশের নেতাকর্মীদের প্রতি তারেক রহমানের বিশেষ বার্তার পর এখন কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে ইফতার মাহফিলসহ যেসব কর্মসূচি চলছে, তাতে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দলীয় ইফতার মাহফিলগুলোতে সম্ভাব্যপ্রার্থীরা বিভিন্নভাবে শোডাউন করছেন। আর গণসংযোগ বাড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছেন। কেউ কেউ নিজের প্রার্থী হওয়া সম্পর্কেও নেতাকর্মীদের মতামত নিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতবিনিময় সভা হচ্ছে। 
সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসন্ন ঈদের পর বিএনপি সারাদেশে সভা-সমাবেশসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন জোরদার করবে। আর এসব কর্মসূচি সফল করতে কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারাও জেলা-উপজেলা সফর করবেন। এছাড়া প্রতিটি সংসদীয় আসনের সম্ভাব্যপ্রার্থীরাও মাঠে সক্রিয় থাকবেন।   
রমাজান মাসে ইফতার মাহফিল কেন্দ্রিক বিএনপির যে কর্মসূচি চলমান রয়েছে, তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, দলীয় ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি, নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা, কেউ যেন কোনো বিশৃঙ্খলায় না জড়ায় সে বিষয়গুলো আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। ইফতার মাহফিলের পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি এলাকায় গুম-খুনে নিহত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
ঈদের পর দেশব্যাপী নির্বাচনমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামাও পর্যবেক্ষণ করবে। আগে ঠিক করে রাখা প্রতিআসনের তিনজন সম্ভাব্যপ্রার্থীর পাশাপাশি এর বাইরে অধিক জনপ্রিয় কোনো প্রার্থীর সন্ধান পাওয়া যায় কি না, তাও পর্যবেক্ষণ করবে দলীয় হাইকমান্ড। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা যায়। 
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে উৎসবমুখর পরিবেশে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ধিত সভায় অর্ধশতাধিক তৃণমূল পর্যায়ের নেতা বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেকের বক্তব্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি উঠে আসে।  আর বর্ধিত সভার সভাপতি তারেক রহমানও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে বলেন। 
সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে মুক্ত থাকতে দলীয় কৌশল ঠিক করেছে দলীয় হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে দলের যে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যখন যে অভিযোগ আসছে, দ্রুত তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গত কয়েক মাসে সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এতে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে এই বার্তা গেছে যে, বিএনপি অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না।  
এদিকে সংস্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত পেতে ছোট বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলের কাছে যাচ্ছে সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে রাজনৈতিক দলের কাছে এসব সুপারিশ পাঠাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশগুলোর প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে মতামত দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হচ্ছে।

মতামত পাওয়ার পরই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সংলাপ শুরু হবে। আর এ সংলাপের মধ্য দিয়ে আসবে নির্বাচনী রূপরেখা। তাই সংলাপে গিয়ে বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রস্তাব তুলে ধরবে। এছাড়া কেন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা ঠিক হবে না, তাও তুলে ধরবে। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এখন সুদৃঢ়। তাই দ্রুত নির্বাচন  হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ জন্যই দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, নির্বাচন কেন্দ্রিক ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ  নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি।

কারণ, সংসদ নির্বাচন না হলে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর জনগণের সরকার না হলে অনেক সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান হবে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য চাপে রাখতে চায় বিএনপি। 
বিএনপির সঙ্গে তাদের সমমনা  কয়েটি রাজনৈতিক দলও দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। এজন্য তারাও নির্বাচনমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তাদের মতে, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের সিংহভাগ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট হলে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে ভোট দেবে। 
গত ১৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছে বিএনপি। বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে চিকিৎসাধীন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তবে তিনি লন্ডনে থাকলেও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছেন। নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলে তিনিও তার মাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
সূত্র মতে, নানা মহলের চাপে নির্বাচন কমিশনও এখন দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি করছে। সম্প্রতি আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টার্গেট করে জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।  আর ডিসেম্বরে ভোট করতে হলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম জুন মাসে শেষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ইসি নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার দরকার বলে কমিশন মনে কওে, সেটুকু করার উদ্যোগ তারা নিয়েছেন। বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, তারা মনে করছেন ডিসেম্বর আসতে আসতে এই পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে তারা এমন একটি জোয়ার সৃষ্টি করবেন, যেখানে ভোট ছাড়া মানুষের আর কোনো চিন্তা থাকবে না। 
বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, বিএনপির সকল কর্মকা- এখন নির্বাচনমুখী। গত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই তারা ভোট দেওয়ার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করছেন। এছাড়া দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। তাই আমরা চাই, ন্যূনতম সংস্কার করে অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুক।

×