
ছবি : জনকণ্ঠ
বগুড়ার পুলিশ লাইনের ভেতরেই ছিল এক ভয়ঙ্কর গোপন বন্দিশালা। যেখানে দিনের আলো ফোটেনি, যেখানে রাতের আঁধারে নির্যাতনের করুণ আর্তনাদ মিলিয়ে যেত নিরবতার গহ্বরে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়, বিশেষত র্যাব-১২ ও জেলা পুলিশের কিছু সদস্য বিরোধী মতাবলম্বী ও সরকারের সমালোচকদের গুম করে এনে এই বন্দিশালায় চালাত ভয়াবহ নির্যাতন।
এই লোমহর্ষক তথ্য উদঘাটন করেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। কমিশনের সদস্য নূর খান ঢাকার গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বগুড়া পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে একেবারে গোপন কারাগারের মতো একটি জায়গা ছিল, যেখানে বন্দিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। এটি একেবারেই অকল্পনীয় ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে রাতের আঁধারে তুলে এনে এই বন্দিশালায় আটকে রাখত। নির্যাতনের নির্মম কাহিনি উঠে এসেছে সেসব ভাগ্যাহত বন্দিদের মুখে, যারা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ফিরে এসেছেন জীবিত। তাদের ভাষ্যমতে, এটি ছিল এক ‘আয়নাঘর’, যেখানে মানুষ শুধু হারিয়ে যেত, ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা থাকত না।
বগুড়া পুলিশ লাইন্সের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দোতলা ভবনটি, যা বর্তমানে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানেই একসময় চলত অমানবিক নির্যাতন।
সূত্র জানিয়েছে, গত ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে এই বন্দিশালায় চলেছে অকথ্য নিপীড়ন। বন্দিদের হুমকি, মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর চালানো হতো ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।
সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী সরেজমিনে পুলিশ লাইন্সে গিয়ে বন্দিশালার অস্তিত্বের সত্যতা পান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ সদস্যও স্বীকার করেছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের খবর শোনা যাচ্ছিল।
এ বিষয়ে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার জানিয়েছেন, “আমরা বিষয়টি শুনেছি, তবে নিজের চোখে দেখিনি। আজ ডিআইজি ও অ্যাডিশনাল ডিআইজি স্যার বগুড়ায় আছেন, তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না।”
এতদিন পর প্রকাশ্যে আসা এই তথ্য দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছে।
পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শেখ হাসিনা সারাদেশে যে সকল পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করেছিলেন তারা সবাই আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তার সব কিছুই করেছেন। এজন্য তারা জেলায় জেলায় বিরোধী মতের প্রতিবাদী মানুষদের ধরে এনে এই বন্দীশালায় আটকিয়ে রেখে নিরযাতন চালানো হতো।
বগুড়ার এই গোপন বন্দিশালা যেন এক বিভীষিকাময় অধ্যায় যেখানে মানুষ গুম হয়ে যেত, ফিরে এলেও ফিরে আসত এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভার বয়ে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কতজন এই অন্ধকার বন্দিশালায় হারিয়ে গেছে, আর কজন ফিরে আসতে পেরেছে?
/মো. মহিউদ্দিন