
স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল, অগ্নিগর্ভ পুরো বাংলাদেশ
স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল, অগ্নিগর্ভ পুরো বাংলাদেশ। দেশ মাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে সবাই রাজপথে। চলছে লাগাতার হরতাল। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত শহর-বন্দর-গ্রামগঞ্জ। অহিংস আন্দোলন-সংগ্রামে নয়, সশস্ত্র সংগ্রামেই একমাত্র মুক্তির পথ, এটা বুঝতে বাঙালির জাতির বাকি রইল না। তাই আন্দোলনের পাশাপাশি সারাদেশেই গোপনে চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি।
কয়েক শতাব্দীর ঔপবিনেশিক দুঃশাসনের পাথার পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ‘পাকিস্তান’ নামে বাঙালির ভাগ্যে যা জুটেছে, তা ভিন্নরূপে আরেক অপশাসন, নির্যাতন আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়। বাঙালি জাতি ওই শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেতে নেমে পড়ে রাজপথে।
উনিশশ’ একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের চার তারিখ ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। তবে এই দিন হরতাল ছিল আট ঘণ্টার। দ্রোহ-ক্ষোভে বঞ্চিত শোষিত বাঙালি তখন ক্রমেই ফুঁসে উঠছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে।
এক্ষেত্রে বসে নেই পাকিস্তানি বাহিনী। তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাতে তৎপর। কার্ফু দিয়েও সামরিক জান্তারা সাহসী বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাঙালি নিধনের ষড়যন্ত্র। শুধু অপেক্ষা করতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলেন।
আন্দোলনের পাশাপাশি সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই।
একাত্তরের এই দিনে অর্থাৎ ৪ মার্চ, ১৯৭১ ক্ষুব্ধ বাঙালীর মিছিলে মিছিলে ঝাঁজালো স্লোগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। প্রধান স্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।
একাত্তরের উত্তাল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বাংলাদেশে এই দিনটিতে সারা দেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে স্থাপন করা হয় ছাত্রদের যোগাযোগ কেন্দ্র।
একদিকে জনসভার প্রস্তুতি, অন্যদিকে গোটা বাংলাদেশেই উত্তাল আন্দোলন-বিক্ষোভে রীতিমত অগ্নিগর্ভ অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি বাঙালির চোখে-মুখে একই প্রত্যাশা- পাকিস্তানি দখলদারদের হটিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনা। আর সেই লক্ষ্যে পূরণেই বাঙালির দামালছেলেরা সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।