
বিশিষ্ট লেখক, দার্শনিক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বলেছেন, সম্প্রতি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে গণ অভ্যুত্থানে কার কি ভূমিকা ছিল তা নিয়ে তরুণদের অনেকে নানান দিক থেকে তথ্য দিয়েছেন, ঘটনাঘটনের বিশ্লেষণ করেছেন। আগামীতে চলমান সংগ্রামের নির্ধারক মূহূর্তে প্রয়োজন বোধ করলে আমরা তাদের আলোচনা বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করব।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফাঁস করে দিয়েছেন যে ‘বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে”। সেটাও নাকি এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে যার নাম কেউ শোনেনি। ট্রাম্প স্বয়ং বিস্ময় প্রকাশ করেছেন: ‘২৯ মিলিয়ন ডলার! তারা চেক পেয়েছে।’ তাই বলি, গণ অভ্যুত্থান তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই গণ অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব দাবি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না।
সোমবার (৩ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
পোস্টে ফরহাদ মজহার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার এখানেই শেষ না। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইয়ং সাউথ এশিয়ান লিডার্স ইনিশিয়েটিভ (YSALI)। এই উদ্যোগটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের তরুণদের জন্য চালু করা হয়েছে। YSALI তরুণদের নেটওয়ার্ক-সুবিধা, নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, পেশাগত বিনিময় ও একাডেমিক ফেলোশিপের সুযোগ দেয়।
তিনি আরও বলেন, আরেকটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ’ (SPL)। এই প্রকল্পটি ইউএসএআইডির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বলা হয় বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের সম্পর্কোন্নয়ন এবং রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাসের লক্ষ্য নিয়ে SPL কাজ করে। তবে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য স্থানীয় ‘এসেট’ তৈরি করা। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সজ্ঞানে সোৎসাহে কাজ করে এমন তরুণদের সংখ্যা কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করবার শক্তিশালী তত্ত্বও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের উন্নতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শ্বার্থ রক্ষা ছাড়া নামগ্লাদেশেরর আর কোন বিকল্প নাই। যুক্ত্রাষ্ট্র যা চায় তা তাকে দিতে হবে। কিম্বা বলা হয় দিল্লীকে মোকাবিলা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দরকার। অথচ ইন্দো-মার্কিন-ইহুদিবাদী অক্ষশক্তি পরস্পর থেকে আলাদা কিছু না। এই অক্ষ শক্তিই বাংলাদেশের জনগণের প্রধান দুষমণ।
ফরহাদ মজহার বলেন, কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তরুণ নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, তাদের স্বার্থ বজায় রাখে এবং সময় মতো ব্যবহার করে। এই ধরণের নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই তরুণদের রাজনৈতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত করে। তাদের স্বার্থের পক্ষে কার্যকর প্রচার চালাতে পারে। সেই ক্ষেত্রে যেসকল মতাদর্শিক প্রচারণা অনবরত চালানো হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বাম রাজনীতির কোন ভবিষ্যৎ নাই, মার্কসের তত্ত্ব ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, কোন শ্রেণী নয় বরং ‘জেন জি’ হচ্ছে প্রধান বিপ্লবী শক্তি, ইত্যাদি। অথচ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের প্রান্তিক একটি দেশ হবার কারণে বাংলাদেশে খেটে খাওয়া নিপীড়িত শ্রেণীর পক্ষে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠবেই, এর কোন বিকল্প নাই। কিন্তু ঔপনিবেশিক মন মানসিকতার ধারাবাহিক উপস্থিতি যেমন আমাদের পিছে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিভিন্ন ভাবে গণরাজনৈতিক ধারারা বিকাশের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। এ কারণেই আমরা শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণী ও জনগোষ্ঠির পক্ষের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চর্চার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা চেতনার উপস্থিতি লক্ষ্য করি। মতাদর্শিক ভাবে ‘সেকেন্ড রিপাব্লিক’-এর ধারণা পর্যালোচনা করবার ক্ষেত্রে এই সকল বাস্তব প্রেক্ষাপট আমাদের মনে রাখতে হবে।
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের যে যারা নিজেদের বাম রাজনীতির ধারক ও বাহক গণ্য করেন তাদের অন্ধ বাঙালি জাতিবাদ, ইসলাম বিদ্বেষ এবং গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট চিন্তাচেতনা এ যাবতকাল গণরাজনৈতিক ধারা বিকশিত করে তোলার প্রধান বাধা হয়ে হাজির ছিল। কিন্তু চোরে বাসন নিয়ে গিয়েছে বলে আমরা মাটিতে ভাত খেতে পারি না। গণমানুষের পক্ষে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের কাজ আমাদের করতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-তরুণদের রাজনৈতিক দল ঘোষণার পর এবং বিশেষ ভাবে ‘সেকেন্ড রিপাব্লিক’ কায়েম করবার লক্ষ্য নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে চলমান রাজনীতির বিশেষ চরিত্র ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টির পেছনে পরাশক্তির প্রভাব রয়েছে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু জনগণকে পরাশক্তির আপদ মেনে নিয়েই লড়াই করতে শিখতে হবে। সেই দিক থেকে সঠিক পথ হচ্ছে জনগণের তরফ থেকে গণ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকা এবং তা বারবার প্রচার করা। সেটা হোল গণসার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) আলোকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গঠন্তন্ত্র প্রণয়নই আমাদের এখনকার কাজ। আকস্মিক ভাবে ‘সেকেন্ড রিপাব্লিক’-এর দাবি আদতে ইন্দো-মার্কিন-ইজরায়েলি অক্ষশক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ ধারণ করে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ নয়।
পরাশক্তির প্রভাব বাংলাদেশের তরুণদের মতাদর্শ ও কর্মসূচি প্রণয়নের মধ্যে থাকবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তাকে খোলাসা করে দেওয়া এবং বড় ক্ষতি হবার আগে শুধরে নেওয়াই আমামদের কাজ। এখন আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ণ এবং গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করবার রাজনীতি আর নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সেকেন্ড রিপাব্লিক’ প্রতিষ্ঠার দাবি এক নয়। বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের নীতি, কৌশল ও রণধ্বনির প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগী হতে হবে- যোগ করেন তিনি।
ফরহাদ মজহার বলেন, ছাত্র-তরুণরা কেন তাদের রাজনীতিকে বৈধতা দেবার জন্য ইংরেজি ব্যবহার করে? বাংলা নয় কেন যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে? এটা কি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনমন্যতা? সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের পার্থক্য প্রচার? হতে পারে।তবে তার অন্য কারণও আছে। প্রধান একটি কারন হচ্ছে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা যারা তরুণদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে। বিভিন্ন কর্মসূচি, ইত্যাদি। একে শুধু ‘জেনারেশান-জি’ বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
সবশেষ তিনি লিখেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তির ভূমিকা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু হুঁশিয়ার থাকলে আমরা এইসব বিপদ কাটিয়ে উঠব, ইনশাল্লাহ।
সজিব