
.
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা ৪০ দিনের ছুটিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তারা বলছেন ঠিক উল্টো কথা! জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি শেষ। মার্চ মাস শুরু হলো। সামনে ৪০ দিনের ছুটি। এর মধ্যে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই জুটল না? এমন হলে তো দেশে আর কোনো শিক্ষা-দীক্ষা থাকবে না। ফলে এমন ছুটিতেও অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে দুশ্চিন্তা।
পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতরসহ বেশ কয়েকটি ছুটি মিলিয়ে রবিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরু হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে আগামী ৮ এপ্রিল। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) গড়ে ৮০ শতাংশের বেশি বই ছাপানোর তথ্য জানিয়েছে। তবে সেসব বই এখনো মাঠপর্যায়ে পৌঁছেনি। যে কারণে গ্রাম, থানা, জেলা এমনকি মহানগরেও সব ক্লাসের সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দিতে পারেনি বোর্ড। এর ফলে চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের চরম শিখন ঘাটতির মধ্যে পড়তে হতে পারে।
সরেজমিন এনসিটিবিতে গত বৃহস্পতিবার একাধিক কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে বই নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে অনেক প্রেস মালিককে সেভাবে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, অনেকে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। কারও আবার শ্রমিক নেই। এমন শত অজুহাতে বই ছাপার কাজ পিছিয়ে রয়েছে। বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে জানান, যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে কাজ নামাতে পারিনি। কিছু ছোট ছোট প্রেস বইয়ের কাজ নিয়ে ঝামেলা করছে। অনেকে এখন কাজ করতেই পারছে না। সক্ষমতা দেখিয়ে তখন কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এখন নানা সংকট দেখাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে। তবে শিক্ষক-অভিভাবকরা বলছেন, পাঠ্যবই ছাড়া কয়েক মাস কাটানো মানে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা শিখন প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে গেছে। উৎসবের বড় ছুটি তাদের শিক্ষা থেকে আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে।
এনসিটিবির তথ্যমতে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৬৬ শতাংশ বই ছাড়পত্র পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অনেক বই শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে। কিছু বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলমান। বাকি ৩৪ শতাংশ বই ছাপার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে মাধ্যমিকের এখনো প্রায় ছয় কোটি বই ছাপানো বাকি।
এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রণ শাখা সূত্র জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণির মোট বই ৬ কোটি ৪২ লাখ। তার মধ্যে ছাপা শেষ হয়েছে ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩৭ হাজার। সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ৮১ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ৪ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার। অষ্টম শ্রেণির বই ৫ কোটি ২০ লাখ ৬৮ হাজার বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ। নবমের ৬ কোটি ১২ লাখ বইয়ের মধ্যে ছাপা শেষ হয়েছে মাত্র ২ কোটি ২০ লাখ ১৮ হাজার কপি।
প্রাথমিকের বই ছাপা-বিতরণ তদারকি করে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ শাখা। এ শাখার কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৪ কোটি ৩৮ লাখ বইয়ের মধ্যে ৪ কোটি ৩৪ লাখ বই ছাপা শেষ। চতুর্থ ও পঞ্চমে ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৬ হাজারের মধ্যে ৩ কোটি ৭৯ লাখ বই ছাপা হয়েছে।
উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, প্রাথমিকের বই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ করতে পারতাম। দু-তিনটি প্রেসের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০-২১ লাখ বই ছাপা বাকি রয়েছে। আশা করি, দ্রুত সেগুলো স্কুলে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
অন্ধকারে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ॥ এনসিটিবি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে যে তোড়জোড় দেখিয়েছে তার ছিটেফোঁটাও দেখায়নি মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থীর বই ছাপার কাজে। এই দুই স্তরের শিক্ষার্থীর কোন শ্রেণির কত শিক্ষার্থী বই পেয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যানও বোর্ড থেকে দিতে পারেনি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অজুহাত হলো- এনসিটিবিতে এখন শিক্ষা সচিব বসে থাকেন। তাকে খুশি করতেই বোর্ড কর্মকর্তা ও প্রেস মালিকরা সর্বদা ব্যস্ত। ফলে এ বছর কারিগরি ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বই ছাপায় গড়িমসি করা হয়েছে, যা চরম বৈষম্য বলেও অনেকে মনে করছেন। এনসিটিবি বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান বিষয়টি জনকণ্ঠের কাছে স্বীকার করেন।
এদিকে বই সন্তানের হাতে এখনো না ওঠায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অভিভাবকরা। এক অভিভাবক বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেল, তাও বই দেওয়া গেল না। এটা মানা যায় না। এখন রোজার ছুটি, ঈদের ছুটি, এসএসসি পরীক্ষার ছুটি। বছরের অর্ধেক সময় তো পার হয়ে যাবে। বই হাতে পেয়ে তিন-চার মাসও লেখাপড়া করার সময় পাচ্ছে না বাচ্চারা। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রত্যাশা করছেন তিনি।
আরেক অভিভাবক শান্তা ইসলাম বলেন, বইয়ের এমন অবস্থা মানে শিক্ষার অবস্থাও ভালো না। বই না থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ানো খুবই কষ্টসাধ্য। তাদের ওপর চাপ দেওয়া যায় না। ক্লাসে মনোযোগীও করা যায় না। এটা শিক্ষকদের পাঠদানের ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা।
শিক্ষকরা জানান, শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী অক্টোবরের মধ্যে বই শেষ করতে হলে যেটুকু এপ্রিলের মধ্যে পড়ানো দরকার সেটুকু পড়ানো যাবে না।
ব্যবস্থা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়। বিগত কয়েক বছর বন্যা-শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র গরমের কারণে একাধিক দিন ক্লাস বন্ধ রাখা হয়। যাতে শিখন ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ঘাটতি পোষাতে গত বছর রমজানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এবার এমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ছুটি শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছুটি কমানো-বাড়ানো নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। সেজন্য আমরাও এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেইনি। পুরো ছুটি শেষে স্কুল-কলেজ খুলবে।
এ বছর বই হাতে পৌঁছে দিতে দেরি হওয়ায় রমজানের ১৫-২০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ক্লাস নেওয়ার দাবি তুলেছিল অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। তাদের সেই দাবি নিয়ে কোনো আলোচনাই করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনকি বই ছাড়া ছুটিতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে পড়বে, তা নিয়েও মাউশি, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আমরা মাউশির ডিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ২০ রমজান পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। তাতে শিক্ষা প্রশাসন কোনো সাড়া দেয়নি।