ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ২৫২ কোটি ডলার

রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে বাড়ছে রিজার্ভ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২ মার্চ ২০২৫

রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে বাড়ছে রিজার্ভ

.

আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ঈদ ও রমজান মাসকে সামনে রেখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কারণে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জানুয়ারিতে ২১ বিলিয়নের ঘরে উঠলেও মাসের মাঝামাঝিতে আকুর বিল পরিশোধ করার পর ফের কমে ১৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে যায়। বর্তমানে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার কারণে রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়নের কাছাকাছি অবস্থান করছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রেকর্ড পরিমাণ ২৫২ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশে নিট রিজার্ভ ছিল এক হাজার ৯৯৪ কোটি ডলার।  ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল দুই হাজার ৫৭ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহও কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া নতুন করে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার কারণেও ডলারের প্রবাহ কিছুটা বেড়ে রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৮৫ কোটি ডলারে উঠেছে। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পৃথক হিসাব মতে, মোট রিজার্ভের পরিমাণ রয়েছে ২ হাজার ৬১১ কোটি ডলার বা ২৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ২০ বা ২ হাজার ২০ কোটি ডলারে উঠেছিল। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পৃথক হিসাব মতে, মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৫৫৪ কোটি ডলার বা ২৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের তিনটি হিসাব সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে প্রথমটি বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত বিভিন্ন তহবিলসহ মোট রিজার্ভ। এর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহজ শর্তের ঋণ (ইডিএফ) ও আরও কয়েকটি তহবিল। দ্বিতীয়টি হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবায়ন পদ্ধতি। এটি বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত তহবিল বা ঋণের অর্থ বাদ দিয়ে একটি তহবিল। এর বাইরে হিসাবটি ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ।
এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। ওই সময় বৈদেশিক ঋণ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কেনার মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানো হয়। বর্তমান সরকারের সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রয়েছে, বিপরীতে বিভিন্ন সোর্স থেকে ডলার যোগ হচ্ছে। এতে কিছুটা বাড়ছে রিজার্ভ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) মানদ- অনুসারে মোট রিজার্ভ নির্ধারণ করা হয়েছে।
রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে যে কারণে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে।  আইএমএফের দেওয়া শর্তপূরণের ক্ষেত্রও অনেকটা সতর্ক ছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হুন্ডি সিন্ডিকেট নিয়ে গভর্নরের বক্তব্যর প্রভাবও পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।  প্রবাসীরাও এখন অনেকটাই সতর্ক। যে কারণে আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে কভিড পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০৪ কোটি ডলাররে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে ২০২৩ থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
প্রতিবেদন বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫-১৬-তে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার এবং সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে। এদিকে প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছে এক হাজার ৮৪৯ কোটি মার্কিন ডলার; যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিটেন্স এসেছিল এক হাজার ৪৯৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে রেমিটেন্স এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বর মাসে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অর্থাৎ বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা ৭ মাস দুই বিলিয়নের বেশি রেমিটেন্স এসেছে বাংলাদেশে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের টাকা আসেনি, নিজস্ব সক্ষমতায় আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি। আমাদের রেমিটেন্স এবং রপ্তানির প্রবাহ ভালো। রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। তবে দুবাইয়ে একটি চক্র রেমিটেন্সের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। দুবাইয়ে অল্প কিছু বাঙালি রয়েছে, আর সেই দেশ থেকে রেমিটেন্স বেশি আসছে। এতেই বোঝা যায়, চক্রটি সক্রিয় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় বাদ দেওয়া হলে বাংলাদেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের মত। পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক বলা যেতে পারে। রমজান ও ঈদের মাস উপলক্ষে মানুষের খরচ অনেকটাই বেড়ে গেছে। যে কারণে প্রবাসীরা তাদের পরিবারের মাঝে অন্য মাসের তুলনায় বেশি পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে ডলার  বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কারণেও রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
রুপালী ব্যাংকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকন্ঠকে বলেন, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বাড়ছে। আগামী দুই এক মাস এই ধারা অব্যাহত থাকবে। রিজার্ভ আরও বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রপ্তানি আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও সহজীকরণ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানির ক্ষেত্রেও নিরুৎসাহী করতে হবে। রেমিটেন্স আয়ের জন্য প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে বৈদেশিক মুদ্রার অর্থছাড়ের বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে বলে জানান।    

×