
.
রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। একই সঙ্গে শুরু হচ্ছে মার্চের গরমও। কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হবে সেচ মৌসুম। সব মিলিয়ে ঊর্ধ্বমুখী বিদ্যুতের চাহিদা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মার্চেই বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা গিয়ে পৌঁছাতে পারে ১৮ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। এর বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকলেও সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হবে ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। ফলে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের সরবরাহ ঘাটতি থাকবে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট। ফলে এই সময়টা সারাদেশে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি খোদ বিদ্যুৎ উপদেষ্টাও স্বীকার করেছেন, লোডশেডিং হবে। তবে এ বছর শুধু গ্রামে নয় শহর এবং গ্রামে সমান হারে লোডশেডিং করা হবে। রোজা রেখে গরমে মুসল্লিদের পোহাতে হবে দুর্ভোগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের বকেয়া বিল না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা প্রাথমিক জ্বালানি কিনতে পারছেন না। এতে করে দিন দিন সরকারের কাছে বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়ছেই। গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে উচ্চ দামের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালাতে হবে। এতে করে সরকারের ব্যয় ও লোকসান বেড়ে যাবে। এ ছাড়া লোডশেডিং হলে মাঠ পর্যায়ে সেচেও ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের খরচও বাড়বে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, আগামী মার্চে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪১৪৯ মেগাওয়াট এবং ২১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সবই বেসরকারি খাতে। বকেয়া বিল না পাওয়ার কারণে এসব উদ্যোক্তা জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। ফলে গ্রীষ্মে ফার্নেস অয়েল চালিত কেন্দ্রগুলো চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও অনিশ্চিত। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়েছে গত বছর। বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতি ইউনিটে গড়ে চার টাকার মতো লোকসান করে পিডিবি। ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয় সরকার। পিডিবি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির টাকা ছাড় করলে বকেয়া শোধ করতে পারবে পিডিবি।
এমন পরিস্থিতিতেও গ্রাহকদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সরকার লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে বিদ্যুতের সাশ্রয় নিশ্চিত করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। নইলে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হবে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদেরই দায়ভার নিতে হবে। তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে সেচ কার্যক্রম ও তীব্র গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় লোডশেডিং এড়ানো সম্ভব নয়। তবে এবারের গ্রীষ্মে শহর ও গ্রামে সমানভাবে লোডশেডিং করা হবে।
ফাওজুল কবির আরও বলেন, রমজানে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রমজানে ও গ্রীষ্মে ১৮ হাজার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত চাহিদা হতে পারে। বিদ্যুৎ খাতে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রমজানে যান্ত্রিক ত্রুটির বাইরে কোনো লোডশেডিং হবে না। তবে গ্রীষ্মে ৭০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। এ সময় কুলিং লোড বাড়ে। তা কমাতে শীতাতপ যন্ত্র ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখলে লোডশেডিং মোকাবিলা সহজ হবে। সবাইকে সহায়তা করতে হবে লোডশেডিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়। তবে আমদানির অর্থ সংস্থান নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা জানান, আগামী মৌসুমের অর্থের চাহিদা অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরকে জানানো হয়েছে। তারা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি জানান, সরকার ব্যয় সঙ্কোচনে জোর দিলেও, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটির বেশি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় বন্ধ রয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। আগামী মার্চে পিডিবি থেকে পেট্রোবাংলার কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দেওয়া হয়েছে।
বকেয়া পরিশোধে সরকার আন্তরিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বকেয়া পরিশোধ নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমরা যে টাকা পরিশোধ করছি না তা না। করছি। কিন্তু যেহেতু দেনার পরিমাণটা বেশি তাই এটি একবারে পরিশোধ করা সম্ভব না। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় করলেই আমরা বকেয়া পরিশোধ করছি। আদানির নতুন এই চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, তারা উৎপাদন বন্ধ করে দেবে- এমন কোনো কথা চিঠিতে উল্লেখ করেনি। বলেছে বিলম্ব ফি দিতে হবে। দেখেন, কেউ যদি টাকা পায় তা হলে সে তো টাকা চাইবেই। কিন্তু আমাদের সক্ষমতার কথাও বিবেচনা করতে হবে। এমন তো না যে, আমরা টাকা দিতে চাই না। টাকা তো দিচ্ছি। পরিমাণে কম হলেও দিচ্ছি। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের পাওনার বিষয়টি নিয়ে কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সত্যি যে, আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমে আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৮ হাজারে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। এক্ষেত্রে যদি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো জ্বালানি কিনতে না পারে তা হলে উৎপাদন ব্যাহত হবেÑ স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তারাও যাতে করে জ্বালানি কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এতদিনের জটিলতা তো একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। ডলারের একটা সংকট তো থেকেই যায়। তবে আমরা পাওনা পরিশোধে আন্তরিক। আশা করি গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সংকট হলেও তা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হবে না।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) তথ্যমতে, গত ৬ মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের পিডিবির কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে। গরমের মৌসুম শুরুর আগেই বকেয়া পরিশোধ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে হবে। না হলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। বিপ্পার বর্তমান সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমাদের বিল সাধারণ ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিডিবি সেটা করছে না। এর ফলে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কিনতে পারছি না। আর ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন সর্বনিম্ন ৪০ দিন সময় প্রযোজন হয়। এখন বিল পাওয়া না থেলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। যে কারণে আসন্ন গ্রীষ্মে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। এর ফলে আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং হতে পারে। ঘাটতি হতে পারে দুই থেতে তিন হাজার মেগাওয়াট।
সময়মতো বকেয়া পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, আসন্ন গ্রীষ্মে বিদুতের চাহিদা মেটাতে এখনই বকেয়া পরিশোধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। এর অন্যতম কারণ জ্বালানি সংকট। যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত গ্যাসের উৎপাদন নেই সেহেতু আমাদের আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে বাড়তি দাম দিয়ে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বেশি খরচ হচ্ছে। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও দীর্ঘদিনের বকেয়ার ফাঁদে পড়েছে। তারাও বলছে গ্রীষ্মে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তাই এখনই সময় আমাদের গ্রীষ্মের প্রস্তুতি হিসেবে বকেয়া পরিশোধে উদ্যোগী হওয়া।