
সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার
রমজান মাস সামনে রেখে পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। খুচরা বাজারে চাহিদামতো ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। হাতেগোনা কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ভোজ্যতেলের মিলগুলো থেকেই সংকটের উৎপত্তি। মিলাররা সাপ্লাই অর্ডার (এসও) কিংবা ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) অনুযায়ী ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে না।
মিলারদের অগ্রিম এসও বাণিজ্য সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি রোজা সামনে রেখে দাম আরও বাড়াতে উৎপাদনের পরিমাণ ‘স্লো’ বা কমিয়ে আনা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ক্রুড সয়াবিন ও সয়াবিন বীজ আমদানি হলেও দাম বাড়ানোর কারসাজিতে তা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা হচ্ছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে তেলের সরবরাহ হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে রোজার সময় ভোজ্যতেলের সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মুদি দোকানগুলোতে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল নেই। বিশেষ করে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। পাঁচ লিটারের ৮৫০ টাকা দামের তেল কিনতে ৯৫০-১ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। তবে এই তেলও সবার কাছে বিক্রি হচ্ছে না। অতি পরিচিত ও রেগুলার কাস্টমারদের কাছেই অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে তেল বিক্রি করা হচ্ছে।
খুচরা দোকানদাররা আক্ষেপ করে জানালেন, একদিকে কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেলের সরবরাহ করছে না, অন্যদিকে যৎসামান্য যা দিচ্ছে তা নিতে হচ্ছে অন্যান্য পণ্য কেনার শর্ত হিসেবে। আবার রয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তদারকি। সব মিলিয়ে ভোজ্যতেল বিক্রি করাটা ছোট ব্যবসায়ীদের ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। দোকানদাররা বলছেন, যেহেতু ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি তাই যতটুকু তেল পাওয়া যাচ্ছে তা শুধু নিয়মিত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের এই সংকট পুরোপুরি ‘কৃত্রিম’। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণেই বাজারে তেলের দাম বেড়েছে, চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না। আমদানিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার শুল্ককরের সুবিধা ব্যবসায়ীদের দেওয়া হলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। ভোজ্যতেল আমদানিতে এখন আর কোনো ভ্যাট ও কর দিতে হয় না ব্যবসায়ীদের।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দাম। বিশেষ করে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে এ বছর বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলের উৎপাদন হয়েছে। দেশগুলো থেকে অনেক কমদামে ভোজ্যতেল আমদানি করতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে ভোজ্যতেলের দাম স্বাভাবিক হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিীন সম্প্রতি সচিবালয়ে জানান, ভোজ্যতেলের দাম দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করছি। ভোজ্যতেল নিয়ে কৃত্রিম সংকট বা কারসাজি করার কোনো সুযোগ ব্যবসায়ীদের দেওয়া হবে না। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো সরকার খতিয়ে দেখছে। অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সরকার।
জানা গেছে, কোম্পানিগুলো মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে। এতে ডিলার থেকে খুচরা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বাড়ানো হচ্ছে দাম। আবার বাড়তি দামেও চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। এতে বাজার থেকে একপ্রকার উধাও হচ্ছে সয়াবিন তেল। চাহিদা দিয়েও অনেক কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদামাফিক বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি দিচ্ছে না। দশ কার্টন তেল চাহিদা দিলে দুই কার্টন তেল দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কিনলে তবেই ভোজ্যতেল মিলছে।
কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। এমনকি পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে মৌলভী বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, মিলগুলো থেকে ডিও অনুযায়ী তেল দেওয়া হচ্ছে না। অগ্রিম টাকা দিয়ে তারা এখন বেশি দামে অন্যদের কাছে তেল বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ভোজ্যতেল নেই। এ সংকট উত্তরণে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এদিকে, সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বুধবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৮৫-১৯০, সয়াবিন তেল বোতল পাঁচ লিটার ৮৫০-৮৫২, সয়াবিন তেল বোতল দুই লিটার ৩৫০-৩৫৫, সয়াবিন তেল বোতল এক লিটার ১৭৫-১৭৮, পামঅয়েল খোলা প্রতি লিটার ১৫০-১৫৩, সুপার পামঅয়েল প্রতি লিটার ১৫৫-১৬২, রাইস ব্র্যান অয়েল প্রতিটি পাঁচ লিটারের ক্যান ১০৫০-১০৭০, রাইস ব্র্যান তেল প্রতি লিটার ২০৫-২১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, টিসিবির দেওয়া এই মূল্য অনুযায়ী খুচরা বাজারে সয়াবিন ও পামঅয়েল পাওয়া যাচ্ছে না।
ভোক্তাকে আরও বেশি টাকা দিয়ে তেল কিনতে হচ্ছে। যদিও রোজায় অতিরিক্ত আড়াই থেকে ৩ লাখ লিটার ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। ওই হিসাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা না হলে তেলের সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রোজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে।
এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। তাই এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়, এর প্রায় সবকটির দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহন খরচ কমেছে। দেশে ডলারের সরবরাহ ভালো। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে।
ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উল্টো আরও বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সার্বিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ ছাড়া কর ও ভ্যাটের সুবিধা নিয়ে আমদানি বাড়লেও সেই তেলের অবৈধ মজুত বাড়ানো হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে সয়াবিন তেলের মাসিক চাহিদা দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন।
সেখানে জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার টন। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টন। গত ছয় বছরের মধ্যে এক মাসের হিসাবে এটিই সর্বোচ্চ আমদানি। আবার একই সময়ে সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবিনবীজ আমদানিও ছিল ৩১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমদানি হওয়া এই তেল প্রক্রিয়াজাত শেষে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বাজারে থাকার কথা। কিন্তু জানুয়ারির বিপুল আমদানির পরও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
এনবিআরের হিসাবে, অপরিশোধিত সয়াবিন ছাড়াও জানুয়ারিতে সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন। ২০২২ সালের জুনের পর এই আমদানিও ছিল সর্বোচ্চ। আমদানিকারকেরা বলছেন, তিন লাখ টন সয়াবিনবীজ থেকে ৪৫ হাজার টন সয়াবিন তেল পাওয়ার কথা। এতে সবমিলিয়ে জানুয়ারিতে সরবরাহ করার মতো তেলের জোগান ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার টন। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩-২৪ লাখ টন।
সেই হিসাবে ভোজ্যতেলের মাসিক চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন। তার মধ্যে সয়াবিন তেলের গড় চাহিদা ৭৯ থেকে ৮৭ হাজার টন। রমজানে এই চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ে। রমজানে সয়াবিনসহ অন্যান্য তেল মিলিয়ে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়ে তিন লাখ টনে উন্নীত হয়।
তথ্যমতে, বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানির বাজারে প্রধান চারটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপ প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা মাল্টিফুড প্রোডাক্টস এবং আবুল খায়ের গ্রুপের স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের ভোজ্যতেল বাজারে প্রবেশ করেছে। বসুন্ধরা তাদের ‘বসুন্ধরা’ ব্র্যান্ড এবং আবুল খায়ের ‘স্টার শিপ’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারজাত করছে।
এ ছাড়া সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানের ভোজ্যতেল বাজারে প্রবেশ করেছে। দুর্নীতির অভিযোগে এস আলম গ্রুপের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানটি এখন আর ভোজ্যতেল আমদানি করছে না। ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো একজোট হয়ে সরকারের কাছে বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সরকার রাজি হয়নি।
ফলে ব্যবসায়ীরা কৌশলে মার্কেটে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা বলেন, তেল নিতে চাইলে কোম্পানিগুলো সঙ্গে পোলাও চাল, হলুদ-মরিচের গুঁড়াসহ বিভিন্ন পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। তবু সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা ক্রেতা যখন দুই লিটার তেল কিনতে চান, তাকে যদি বলি, সয়াবিন তেলের সঙ্গে অন্য যে কোনো পণ্য কিনতে হবে, তখন ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিত-া হয়।
এ কারণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আমাদের জরিমানাও করছে, আমরা পড়ছি উভয় সংকটে। এ প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও যদি সংকট সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে এই সংকটের জন্য আমরা দায়ী না। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী। বেশি মুনাফার আশায় অতীতেও এ ধরনের ঘটনার কথা আমাদের জানা আছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই টি কে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) এবং সিটি গ্রুপও সয়াবিন তেল আমদানি করছে। টি কে, এমজিআই ও সিটি গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে টি কে গ্রুপের ৪৩ হাজার টন, এমজিআইয়ের ৫০ হাজার টন এবং সিটি গ্রুপের ২৬ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হচ্ছে।
এর বাইরে অন্যান্য কোম্পানির ১১ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানির হিসাব পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, আমদানি করা অপরিশোধিত তেল খালাস করে দ্রুত পরিশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি, খুব দ্রুত এই তেল বাজারজাত করা সম্ভব হবে।