ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১

সর্বত্র আলোচনা

ট্রাম্পের বলা ২৯ মিলিয়ন ডলার কোথায় গেল, কে নিয়েছে?

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্পের বলা ২৯ মিলিয়ন ডলার কোথায় গেল, কে নিয়েছে?

যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ বাতিল

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ বাতিল, দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তৃতার পর সেটি কোটি টাকার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, দোকান-পাট রাস্তা ঘাটে একটাই আলোচনা কীভাবে বাংলাদেশে এসেছে মার্কিন টাকা, সেগুলো কীভাবেই বা বাংলাদেশে বিতরণ হয়েছে। সর্বত্র ছিল একই আলোচনা। 
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যানুসারে মাত্র দুইকর্মীর এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই টাকা জমা হয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর থেকে মানুষের মুখে মুখে মার্কিন টাকার খবর। তবে সেই টাকার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি খোদ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মার্কিন ডলারের খরচ ও কার মাধ্যমে এসেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না। সে কারণে মানুষের আগ্রহ আরও বেশি।

যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই না জানে তাহলে কীভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের এত টাকা রাজনীতি শক্তিশালী করতে বাংলাদেশে ঢুকল। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী কাজে বরাদ্দ তহবিল বাতিলকে যৌক্তিকতা দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন মন্তব্য করেছেন।
জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) জন্য সরকারি তহবিল থেকে ২৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা) বরাদ্দ করা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং যুক্তরাজ্যের সদ্য বিলুপ্ত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ডিএফআইডি) অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর শক্তিশালীকরণের (স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ ইন বাংলাদেশ–এসপিএল) প্রকল্পে ধাপে ধাপে অর্থ ছাড় করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অনুদান ও সহায়তা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হাইয়ারগভ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

হাইয়ারগভের ওই পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রকল্পের মেয়াদ প্রথমে ২ বছর আর সর্বশেষ ১ বছর ৭ মাস বাড়ানো হলেও ডিএফআইডি অর্থায়নের প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছিল। তবে বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল ইউএসএআইডি।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের এসপিএল বাস্তবায়নে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছিল ইউএসএআইডি ও ডিএফআইডি। পাঁচ বছর মেয়াদি ওই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এ দুটি সংস্থা নিজেদের মধ্যে চুক্তিও করেছিল। প্রকল্পের মেয়াদ প্রথমে ২ বছর আর সর্বশেষ ১ বছর ৭ মাস বাড়ানো হলেও ডিএফআইডি অর্থায়নের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। তবে বাংলাদেশে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল ইউএসএআইডি।
দুইদিন যাবত সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনার পর প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে সোমবার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেওয়া তথ্যানুসারে কাকে টাকা দেওয়া হয়েছে এবং কে সেটা খরচ করেছে, আমার কাছে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। আপনাদের মতো আমিও পত্রিকায় দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকে খরচের জন্য এই অর্থ দেওয়া হয়েছে।

এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো বলেছে, এমন কোনো এন্ট্রি তাদের নেই। আপাতত তাদের কথাই আমাদের মেনে নিতে হবে। তারপরও যদি কোনো তথ্য বের হয়, তাহলে আমরা সেটা দেখব।
এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতাবিষয়ক বিভাগ (ডিওজিই) তাদের ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নানা প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্প ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ ইন বাংলাদেশ’-এ ২৯ মিলিয়ন (২ কোটি ৯০ লাখ) ডলার অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে। আর গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অর্থায়ন বাতিলের বিষয়টি আবার উল্লেখ করেন।
হাইয়ারগভের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ডিআইয়ের প্রকল্প শুরুর পর থেকে ২০২২ থেকে ২০২৫ সালে শেষ হওয়া বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পের জন্য ১৬ দফায় প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল। আর ২০২৪ সালে শেষ হবে, এমন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।
২০১৭ সালের মার্চে চুক্তি সইয়ের পর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয় মার্চে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মাধ্যমে ২৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার জন্য চুক্তি হয়েছিল। ইউএসএআইডির বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ৮ বছর ৭ মাস নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে এসপিএল প্রকল্পটি কী, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাস করার পাশাপাশি দলের সক্ষমতা তৈরি এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের জন্য কাজ করবে। এই প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারী, যুবক এবং তৃণমূল কর্মীদের যুক্ততার স্বার্থে বাংলাদেশের সাতটি বিভাগে দপ্তর পরিচালনা করে।

এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কাঠামোর উন্নয়ন, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বের বিকাশে উৎসাহ দান। এই প্রকল্পে রাজনৈতিক সহিংসতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহিংসতার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে এর শান্তিপূর্ণ বিকল্পের প্রচারে রাজনৈতিক দল, তৃণমূল কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্পৃক্ত করে। প্রকল্পে অংশীদার হিসেবে এশিয়া ফাউন্ডেশন সহায়তা করবে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালকে।

ওই প্রকল্পের অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ৪০টি জেলায় ‘শান্তিতে বিজয়’ শীর্ষক প্রচার কর্মসূচি চালিয়েছিল। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মাধ্যমে ২৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার জন্য চুক্তি হয়েছিল। ইউএসএআইডির বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ৮ বছর ৭ মাস নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।
এদিকে বাংলাদেশে বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও খাত নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির। এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, এটি (ট্রাম্পের দাবি) একটি অস্বাভাবিক দাবি। আমার মনে হয় ইউএসএআইডির অর্থায়ন বাতিলকে বৈধতা দিতে এখানে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এভাবে কোনো সংস্থার অর্থ নেওয়ারই সুযোগ নেই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন ২৯ মিলিয়ন ডলার যদি এমন কোনো সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা। কারণ এক ডলারই হোক আর ২৯ মিলিয়ন ডলারই হোক- সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো অর্থ ছাড় হওয়া অসম্ভব। আর এককভাবে কোনো সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার খবরটিই অস্বাভাবিক। তবে ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের সামাজিক ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

×