
জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি আজকে বলে দিলাম নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। আমার অন্য কোনো আকাক্সক্ষা নাই। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন এইট মান্থস। আই হ্যাড এনাফ।’
মঙ্গলবার জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে রাজধানীর রাওয়া ক্লাবের হেলমেট হলে ২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকা-ে শাহাদাতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘আমি চাই দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব। আরেকটা জরুরি বিষয় যেটা ভাবলাম যে, আপনাদের সঙ্গে আমি শেয়ার করি, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণটা হচ্ছে আমরা নিজেরা হানাহানিতে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত।
এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি। তারা খুব ভালোভাবেই জানে যে এই সময়ে যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায় তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সেই কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি একত্রিত থাকি তাহলে অবশ্যই এটা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই এরা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে অতীতে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। আজকে যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে এটার কারণ হচ্ছে এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনা সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছে।
সেই জন্য আজকে এতদিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে যারা কাজ করেছে যদি অপরাধ করে থাকে সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। না হলে এই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে আমরা এমনভাবে কাজটা করব এই সমস্ত অর্গানাইজেশন যেন আন্ডারমাইন্ড না হয়।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না একটা বিশাল বড় কারণ হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে। র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড। বিভিন্ন দোষারোপ, গুম, খুন ইত্যাদির তদন্ত চলছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এমনভাবে কাজটা করতে হবে যেন এই অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন্ড না হয়। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে যদি আন্ডারমাইন্ড করে আপনারা মনে করেন যে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না, সেটা সম্ভব না। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব খালি সেনাবাহিনীর না। দুই লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, র্যাব আছে, আনসার ভিডিপি আছে। আমার আছে ৩০ হাজার সৈন্য। এদের দিয়ে এই যে একটা বিরাট শূন্যতা আমি এই ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে কীভাবে এটা পূরণ করব। ৩০ হাজার থাকে আবার ৩০ হাজার চলে যায় ক্যান্টনমেন্টে আরও ৩০ হাজার আসে। এটা দিয়ে আমরা দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এখানে যে সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল কাজ হয়েছে সেটা আমাদের নিজস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচার। আমরা নিজেরা এইগুলো তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তি-শৃঙ্খলা আসবে না। এই জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘তদন্ত কমিশন হচ্ছে আবার আরেকটা আমাদের। সর্বদা আমরা চেষ্টা করব তদন্ত কমিশনকে সহায়তা করতে। যে ধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আমরা করব। আমরা দেশে একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ একটা ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি এবং তার আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবেন।
আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি হি কমপ্লিটলি এগ্রিস উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইদিন ডিসেম্বর অর ক্লোজ টু দ্যাট। যেটা আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে ১৮ মাসের মধ্যেই একটা ইলেকশন। আমার মনে হয় যে সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে, কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে তিনি যেন সফল হতে পারেন। সেই দিকে আমরা সবাই চেষ্টা করব। আমরা একসঙ্গে ইনশা আল্লাহ কাজ করে যাব।’
তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি না করে আমরা ইউনাইট আওয়ারসেলভস। দেশ জাতি যেন একসঙ্গে থাকতে পারি, সেদিকে আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তা-চেতনার বিরোধ থাকতে পারে কিন্তু দিনশেষে যেন আমরা সবাই দেশ এবং জাতির দিকে খেয়াল রেখে এক থাকতে পারি। তাহলেই এই দেশটা উন্নত হবে। এই দেশটা সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব। বিশ্বাস করুন। ওই দিকে আমরা যেতে চাই না।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম। নাইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।’
তিনি বলেন, ‘এই দেশ সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি-কাটাকাটি-মারামারি। সেই উদ্দেশ্যে আমি কাজ করে যাচ্ছি, আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণ করবেন না। একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারও কারও, কী কারণে আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।
আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে, অফকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অল। উই অল। আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করুন। আমাদের উপদেশ দিন।’
সেনাপ্রধান বলেন, বলেন, ‘আমি সবার শরণাপন্ন হই। আমাদের আক্রমণ করবেন না। উপদেশ দিন আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’
পিলখানা হত্যাকা-ের বিচারিক প্রক্রিয়া নষ্ট করবেন না ॥ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের হেলমেট হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান এই আহ্বান জানান।
সেনাপ্রধান বলেন, ‘একটা জিনিস আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ (যদি ও কিন্তু) নাই।
এখানে যদি ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ আনেন, এই যে বিচারিক কার্যক্রম এত দিন ধরে হয়েছে, ১৬ বছর ধরে, ১৭ বছর ধরে যারা জেলে আছে, যারা কনভিকটেড, সেই বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজন। এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আজকে একটা বেদনাবিধুর দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা এই ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসার এবং শুধু তা-ই নয়, তাঁদের কিছু কিছু পরিবারের সদস্যদের আমরা হারিয়েছি। এখানে আসার সময় এই ছবিগুলো আমি দেখছিলাম। এই ছবিগুলো আপনারা অনেকে ছবিতে দেখেছেন। কিন্তু এগুলো আমার সব চাক্ষুষ দেখা। আমি একটা চাক্ষুষ সাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার।’
তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে জড়িত ছিল কি না, ইনভলব ছিল কি না, বাইরের কোনো শক্তি এর মধ্যে ইনভলব ছিল কি নাÑ সেটার জন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান এখানে আছেন। তিনি এটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘বটমলাইন হচ্ছে যে এই সমস্ত, আমাদের এই চৌকস সেনাসদস্য, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা নিজেরা এসব জিনিস নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, কোনো ব্যত্যয় থেকে থাকে সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়ে কোনো লাভ হবে না, নিজের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না। আমি আপনাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করে দিচ্ছি।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘কিছু কিছু সদস্যদের দাবি, তারা ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন, তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেই বোর্ডের সদস্য। প্রথম ধাপে ৫১ জন সদস্যের ব্যাপারে আমার কাছে রেকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। রেকমেন্ডেশনের অধিকাংশ আমি গ্রহণ করেছি। নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীও তাদের এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য কোনো ছাড় হবে না, বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের স্পষ্ট করে দিচ্ছি। এটা একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্স, ডিসিপ্লিনড ফোর্সকে ডিসিপ্লিনে থাকতে দিন। আজকে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সমস্ত বাহিনী সমস্ত অর্গানাইজেশন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু সেনাবাহিনী টিকে আছে।
বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী টিকে আছে। কেন? বিকজ অব ডিসিপ্লিন। আমি আমার অফিসারদের আদেশ দিয়েছি, যদি সামান্যতম কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে যে কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে, অপরাধী কি-না, যদি সামান্য কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, সেটা তাদের পক্ষে যাবে। এটা হচ্ছে আমার ঢালাও নির্দেশ।’