ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১

সংকট মোকাবিলায় আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক

বিদেশী ঋণ শোধে ডলারের জোগান পাওয়া কঠিন হতে পারে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিদেশী ঋণ শোধে ডলারের জোগান পাওয়া কঠিন হতে পারে

ডলারে ঋণের দায় শোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে

শেখ হাসিনা সরকারের হাতে জিম্মি থাকা অর্থনীতির চাপ সামলাতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ডলারে ঋণের দায় শোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাপে থাকা ব্যাংকগুলোকেও অন্য ব্যাংক থেকে ডলার ধার করতে হচ্ছে। তথ্যমতে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের দায় শোধে মোট সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।

অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১১.৭ বিলিয়ন ডলার শোধ করা হয়েছে। তবে সামনে আরও ১২.৭২ বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটের এই সময় দায় শোধের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান পাওয়া কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মোট ১০৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে সরকারি ঋণ ৮৪.৪ বিলিয়ন ডলার। বাকি ১৯.৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। সরকারের ৮৪.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। কারণ সরকারের বেশির ভাগ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১.৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। বাকি ছয় মাসে পরিশোধ করতে হবে ২.৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসের তুলনায় পরবর্তী ছয় মাসে বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৯.৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আগামী ছয় মাসেও ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রয়োজন। সুতরাং ডলার আয় না বাড়ালে অর্থবছর শেষে বিপাকে পড়বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক খাত। যদিও রেমিটেন্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি দেখে ডলার সংকট মোকাবিলায় আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ ভালো। প্রতিমাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসছে। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের প্রবাহটাও ভালো। তাই আমরা আশা করছি, অদূর ভবিষ্যতে ডলার সংকট তৈরি হবে না। কারণ এরই মধ্যে রমজানকেন্দ্রিক প্রচুর পণ্য আমদানি হয়ে গেছে। হজের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারও পরিশোধ হয়ে গেছে।

তাই নতুন করে ডলারের চাহিদা তৈরি হবে না। তাছাড়া প্রতিমাসে আমদানি দায় মেটানোর জন্য যে ডলার প্রয়োজন হবে, তা রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের ডলার দিয়েই মেটানো সম্ভব। তাই আমরা আশা করছি, এ বছর নতুন করে ডলার সংকট তৈরি হবে না।’
গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে সাধারণ আমদানি ও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির সব ওভারডিউ পেমেন্ট দ্রুত পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দেয়, নির্দেশনা না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর থেকেই ডলারের চাহিদা বাড়ে। গোপনে বাড়তে শুরু করে ডলারের দামও।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকগুলোর জন্য রেমিটেন্সে ডলার কেনাবেচার সর্বোচ্চ দর ১২২ টাকা নির্ধারণ করেছিল। একই সঙ্গে এক নির্দেশনা জারি করে বলা হয়, ডলার কেনাবেচার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান এক টাকার বেশি হওয়া যাবে না। নিয়ম ভাঙলে জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।

নির্দেশনা মেনে ব্যাংকগুলো রেমিটেন্সে ডলারের দর সাড়ে ১২১ টাকা থেকে ১২২ টাকার মধ্যে রেখেছিল। তবে ওভারডিউ পেমেন্টের চাপ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলার সংগ্রহের প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। ফলে দরও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামে সব সময় ব্যাংক থেকে ডলার পাওয়া যায় না। বেশি দাম দিয়ে খোলাবাজার থেকে কিনতে হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহ আহসান হাবীব বলেন, ‘অনেক দিন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল আছে। তবে ভবিষ্যতে বিদেশী বিনিয়োগ এবং এক্সপোর্ট প্রমোশন করতে না পারলে চাপ তৈরি হতেও পারে। তবে এমন সমস্যা না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এখন প্রতিমাসে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ছয় বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দুই বিলিয়ন রেমিটেন্স এবং চার বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়। যদিও কোনো কোনো মাসে বিদেশী ঋণ আসছে, তবে তার পরিমাণ খুবই অল্প এবং প্রতি মাসে আসছে না বিদেশী ঋণ।

অন্যদিকে আমদানি বাবদ প্রতিমাসে গড়ে খরচ হচ্ছে পাঁচ বিলিয়ন এবং বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ছয় বিলিয়ন ডলার আয়ের বিপরীতে খরচ প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার। অর্থবছর শেষে সামষ্টিক ঘাটতি ডলার বাজারে অস্থিরতা বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ইকোনমিস্ট ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. মশরুর রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, বৈদেশিক ঋণের চাপ বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বৈদেশিক ঋণ আমাদের সব সময়ই প্রয়োজন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ ১০ বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো ধরনের বাছবিচার না করেই বড় বড় মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে  বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে কারণে বড় একটি বোঝা চেপে গেছে।

সরকারকে এখন ঋণের পরিস্থিতি বুঝে পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নিতে হবে। তাহলে বার্ষিক চাপ কিছুটা হলেও কমবে।  বেশি লাভের ঋণের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে। সামনের দিনে  বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বুঝে ভালো করে বিশ্লেষণের পর ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

×