
.
সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে মারাত্মকভাবে। ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্যরা। প্রায় প্রতিদিনই তাদের অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ে অভিযোগ উঠছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের নতুন তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারসহ পুলিশের সব ইউনিটকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিশোর-তরুণদের সব গ্যাং।
দেশে চলমান ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’র বিশেষ অভিযানের মধ্যেই কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অনেক অভিযোগ বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের যে তালিকা রয়েছে, তাতে ২৩৭টি গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে রাজধানীতে সক্রিয় আছে অন্তত ১২৭ কিশোর-তরুণের গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা দুই হাজার ৩৮২ জন। দেশের প্রতিটি থানায়ই কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের তালিকা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ও পরে দেশের বেশিরভাগ থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ. লুটতরাজে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সঙ্গে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের তালিকাও ধ্বংস হয়ে গেছে। এজন্য নতুন করে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গত দুই বছরে ৩৪ জন কিশোর নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় গত বছর ২৫টি হত্যাকা- ঘটায় তারা। এসব হত্যাকা-ের নেপথ্যে ছিল চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, নারীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ প্রভৃতি ঘটনা। এসব হত্যাকা- ঘটানো হয় খুব নৃশংসভাবে। ছুরিকাঘাত করার পর ইট ও লাঠি দিয়ে মেরে পুরো শরীর, মুখ, মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হত্যার পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে খন্ডবিখন্ড করার ঘটনাও আছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আট থেকে দশজনের একটি দল। সবাই কিশোর। শরীরে কালো পোশাক, মুখে মাস্ক, হাতে ধারালো চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র। সড়কের পাশে আড্ডারত চারজন ব্যক্তির ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় দলটি। সম্প্রতি একটি ঘটনার তদন্তে দেখা যায়, দুজন দৌড়ে পালিয়ে বাঁচলেও বাকি দুজনকে কোপানো হয় চাপাতি দিয়ে। এর পর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র ১০ মিনিটের ঘটনা। একই পদ্ধতিতে অন্তত ১০ দোকানি ও পথচারীকে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি ও মারধর করে মোবাইল ফোনসহ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে দলের সবাই। রাজধানীসহ সারাদেশে নিত্যনতুন কায়দায় অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। এর সঙ্গে উঠে আসছে কিশোর গ্যাংয়ের নাম। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারধর থেকে শুরু করে খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে রিক্সাযাত্রী মেহেবুল হাসান ও নাসরিন আক্তার ইপ্তির ওপর চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় মেহেবুলের সামনে নাসরিন দাঁড়িয়ে চাপাতি বাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা করে। এই হামলার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে সড়কে এক রিক্সাযাত্রী দম্পতিকে চাপাতি বাহিনী তাদের চাপাতি দেখিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করে মোটরসাইকেলে চলে যায়। এ ছাড়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা যা খুবই ভয়াবহ। রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন টিনশেড বাড়ির ওপর এক কিশোরকে চার-পাঁচ জনের কিশোর গ্রুপ চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্যে কোপাতে দেখা যায়। মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ের ফুটপাতে গভীর রাতে এক পথচারীর কাছ থেকে ছিনতাই করার সময় চাপাতি বাহিনীর চকচকে চাপাতি প্রদর্শনের দৃশ্যও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এর আগে যাত্রাবাড়ীতে রিকশায় এক দম্পতির কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় চাপাতি বাহিনী। এ সময় চাপাতির আঘাতে স্বামী গুরুতর আহত হন। তারও আগে আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে গ্যাংয়ে কয়েকশ সদস্য। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন। গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য চাপাতি দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে আহত হন পুলিশের চার সদস্য। নেতৃত্ব দেয় ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। সব মিলিয়ে হামলা চালায় ৩০-৪০ জন। পুলিশ জানায়, হামলার ঘটনার নেপথ্যে রায়েরবাজার বোর্ডঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, বরাবরই উত্তরা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্য বেশি। এই এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন এমএম বয়েজ, নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার ও তুফান; মিরপুর এলাকায় বিচ্ছু বাহিনী, সুমন গ্যাং, বিহারি রাসেল, পিচ্চি বাবু, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং ও মোবারক গ্যাং; ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এমএম ও ফাইভ স্টার বন্ড; বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং; তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং; মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিউম টু ও ভান্ডারী; পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপ; রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডাইল্লা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, ইমন গ্রুপ, আনোয়ার ওরফে শ্যুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, দ্য কিং অব লও ঠেলা গ্রুপ, ডায়মন্ড গ্রুপ, আই ডোন্ট কেয়ার (আইডিসি) গ্রুপ, মুরগি গ্রুপ, সাব্বির গ্রুপ, শাওন গ্রুপ, ফিল্ম ঝিরঝির গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল ও কোপাইয়া দে গ্রুপ।
ডিএমপি সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্র (চাপাতি, বেকি, বার্মিজ চাকু, কিরিচ) রয়েছে। মোহাম্মদপুর, আদাবর, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের চাপাতি বাহিনীর দাপট রয়েছে।
ঢাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন পরপর কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা গণছিনতাই চালায়, আবার দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে ভয় লাগে তাদের। মহড়া দেওয়ার সময় বাসাবাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর, লাইট ভাঙচুর করে গ্যাংয়ের সদস্যরা। আদাবর এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারিদের নেতৃত্বে চলছে কিশোর গ্যাংগুলো।
পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি স্থানে একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের কয়েক হাজার সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকান্ড আগের চেয়ে বেড়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক গনমাধ্যমে জানিয়েছেন, বেপরোয়া কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে ডিবি কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক জন গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সময় বদলালেও পাল্টায়নি কিশোর-তরুণদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। বিগত সরকারের সময়ে তাদের সে সময়ের ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে শুরু করে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা শেল্টার দিতেন। বর্তমানে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সমাজে নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া কিছু উঠতি সন্ত্রাসী। এ ছাড়া রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় জামিনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও এখন কিশোর গ্যাংকে শেল্টার দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে যারা দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত তাদের নিয়ন্ত্রণেও আছে কিশোর-গ্যাং।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেছেন, কিশোর-তরুণ গ্যাং নিয়ন্ত্রণই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেসব ব্যত্যয় রয়েছে, সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনের বিষয়গুলোতে আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। পাশাপাশি সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বরাবরের মতোই র্যাবের সব ইউনিট দেশে কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।