ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

প্রস্তাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করবে

প্রকাশিত: ১৬:৪৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৬:৪৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রস্তাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করবে

প্রস্তাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির সংকীর্ণ লক্ষ্যমাত্রার কারণে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এর বদলে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে এবং এ খাতের উদ্যোক্তারা আরও বেশি মুনাফাভোগী হবে। এতে জনগণের ওপর নতুন করে আর্থিক চাপ বাড়বে।

রবিবার উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন)-এর উদ্যোগে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন।সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ক্লিন-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী।

তিনি বলেন, আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নে সবসময় সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে এ খাতের সফলতা অধরা থেকে যাচ্ছে এবং ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।   

তিনি বলেন, সরকার একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নে চার বছরের অধীক সময় নিয়েছে, তবে বর্তমানে কোনো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা নেই। ফলে পরবর্তীতে এই নীতিমালা সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া খসড়া নীতিমালা প্রণয়নে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য মাত্র ২১ দিন দেওয়া হয়েছে যা একেবারে যথেষ্ট নয়। 
হাসান মেহেদী বলেন, খসড়া নীতিমালাটিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য কমানো হয়েছে যা বাস্তবসম্মত নয়— ২০৩০ সালের মধ্যে ৬,১৪৫ মেগাওয়াট (২০%) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৭,৪৭০ মেগাওয়াট (৩০%)। এটি ডিকার্বনাইজেশনের জন্য কোনও স্পষ্ট রোডম্যাপ প্রদান করেনি। এটি একটি ‘গ্রীন ট্যাক্সোনমি’ অন্তর্ভুক্ত করেনি, যা পৃথিবীর বহু দেশ যুক্ত করেছে। এছাড়া নপবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন কৌশল বা অর্থায়ন ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানিগুলো ১০ বছর সম্পূর্ণ এবং ৫ বছর আংশিক কর অব্যাহতি পেলেও সাধারণ নাগরিকরা কোনও কর সুবিধা বা প্রণোদনা পাচ্ছে না। অন্যদিকে, অন্যান্য দেশে ছাদ সৌর প্যানেল স্থাপনে সরাসরি ৩০% পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালায় এমন কোনও সুবিধা রাখা হয়নি।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "প্রস্তাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালাটি প্রণয়নে সরকার বেশ তাড়াহুড়ো করছে। ফলে একটি দায়সারা ড্রাফট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের ভিন্ন ভিন্ন পলিসিতিতে ভিন্ন ভিন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনা থাকায় বিনিয়গকারীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিকল্পনাগুলো অত্যন্ত সুসংহত হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ততটা সুসংগঠিত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার সম্ভব নয়।

এছাড়াও, নীতিমালাটি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপেক্ষা করেছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জ্বালানি লক্ষ্য অর্জনে দেশীয় অর্থায়নের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরী। তদুপরি, বাংলাদেশকে ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (IEPMP)-এর উপর নির্ভরশীল না থেকে আরও নির্ভুল বিদ্যুৎ চাহিদা পূর্বাভাস গ্রহণ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রক্ষেপণ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি না হলে কার্যকর হবে না বলে মনে মন্তব্য করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। 

ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ এশিয়া প্যাসিফিকের সমন্বয়কারী বারিশ হাসান চৌধুরী বলেন, "বেশিরভাগ দেশ নেট-জিরো লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ এখনও এ ধরনের কোনও লক্ষ্য স্থির করেনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার সংজ্ঞাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর। যদিও এটি কার্বন নির্গমন হ্রাসের কথা উল্লেখ করেছে, তবুও নির্দিষ্ট পরিমাণ বা সময়সীমা নির্ধারণ করেনি। নীতিমালায় ‘কার্বন মার্কেট’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা এই প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক। তাছাড়া, ভবিষ্যৎ জ্বালানি পরিবর্তনের জন্য এটি কোনও বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেনি। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া এই নীতিমালা এক ধরনের দিকনির্দেশনাহীন নৌকার মতো, যা বাস্তবে কার্যকর ফলাফল দিতে পারবে না।”

সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, "আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে করা হয় যেখানে লক্ষ্য খুবই অস্পষ্ট। কোন উৎস থেকে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ উতপাদন করা হবে তাও উল্লেখ থাকে না। ফলে লক্ষ্য্ অর্জন করা সম্ভব হয় না। অথচ চায়না, পাকিস্তান, ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো দ্রুত গতিতে এ খাতে সফলতা অর্জন করছে। 

তিনি বলেন, আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত উপেক্ষিত কারণ আমরা প্রকারান্তরে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করছি। অথচ বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানি টেকনোলজির দাম কমছে। আগামী ২০ বছর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে যে অর্থ ব্যয় হবে তা দিয়ে এর চেয়ে ১০ গুণ সক্ষমতার নবায়নযোগ্য জ্বালানি স্থাপন করা সম্ভব। এজন্য সরকারের তরফ থেকে শুধু বাস্তবসম্মত নীতি সহায়তা প্রয়োজন। জীবাশ জ্বালানি ভিত্তিক প্রকল্পগুলো যে সহায়তা পাচ্ছে সেই সহায়তা পেলে বেসরকারি বিয়োগেই এ খাত এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী।

স্বপ্না/রাজু

×