ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১

স্রেফ রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়

ডেমু ট্রেন এখন বিষফোঁড়া

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২২:০৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ডেমু ট্রেন এখন বিষফোঁড়া

.

দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেনের যুগে প্রবেশ করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়েবিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের কাছে এবং আশপাশের জেলা-উপজেলার অফিসগামী যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের জন্য কেনা হয়েছিল ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট)অথচ সেই ট্রেনগুলো এখন বিষফোঁড়ানা হচ্ছে মেরামত, ফলে পড়ে আছে ওয়ার্কশপেদ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কোটি কোটি টাকার এসব ট্রেন কিনে মূলত রাষ্ট্রের অপচয় করেছিল বিগত সরকার

মূলত স্বল্প দূরত্বে উন্নত যাত্রীসেবা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ডেমু কেনা হলেও তা সরবরাহ করা কোম্পানির নিয়ম না মেনে বিগত সরকারের এমপি ও রেলমন্ত্রীদের বাড়াবাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্বে চলাচল করায় নষ্ট হয়ে পড়ে এসব ট্রেনএ ছাড়া সিঁড়ি থেকে স্টেশনের প্লাটফর্মের উচ্চতা সমস্যার কারণে ওঠানামা কষ্টসাধ্য থাকায় বয়স্ক ও নারী যাত্রীদের অনাগ্রহ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে এ প্রকল্পএকইসঙ্গে চীন থেকে কেনা এসব ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় দেশী প্রকৌশলীরা মেরামত করেও সুবিধা করতে পারেনিপ্রযুক্তিগত সমস্যা ও স্বল্প আয়ুষ্কালের এসব ট্রেন এখন রেলওয়ের বোঝা বলছেন রেল প্রকৌশলীরা। 

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানায়, মিটারগেজ সেকশনে কম গতিসম্পন্ন ট্রেন প্রত্যাহার করে দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেন প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে ডেমু ট্রেনের যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিলচীন থেকে কেনা ২০ সেট ডেমুর মধ্যে ২০২১ সালেই অচল হয়ে পড়েছিল ১৩ সেটএরপর মেরামত করে ৭ সেট সচল করেছিলএখন সেগুলোও অকোজোবর্তমানে ২ সেট সচল থাকলেও বারবার বন্ধ হয়ে পড়ায় এবং সফটওয়্যার জটিলতায় সেগুলোও পড়ে আছে রেলওয়ের শেডে

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ট্রেনগুলো কেনা হয়েছিল২০১৩ সালে এসব ট্রেন চালু করা হয়েছিল রীতিমতো আনন্দ উদযাপন করেকিন্তু আসল বিষয় হলো এসব প্রকল্প থেকে সরকারী অর্থ অপচয়ই হয়েছে

বর্তমানে রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নয়ডেমু পরিচালনার দায়িত্ব থাকা এক কর্মকর্তা জানান, চীন থেকে সরঞ্জাম কিনে এসে জোড়াতালি দিয়ে আবারও ট্রেনগুলো কয়েকদিনের জন্য চলাচল উপযোগী করতে চেষ্টা করছিল রেলওয়ে ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্তকিন্তু পুরো ডেমু ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা

জানা গেছেএসব ট্রেন যে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়, তা শুরু থেকেই বলে আসছিল বিশেষজ্ঞরাকিন্তু রেলওয়ের সে সময়ের কতিপয় কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ২০১৩ সালে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের একটি কোম্পানি থেকে কিনে ডেমুস্বল্প দূরত্বে উন্নত যাত্রীসেবা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ডেমু কেনা হলেও তা সরবরাহ করা কোম্পানির নিয়ম না মেনে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্বে চলাচল করায় নষ্ট হয়ে পড়ে এসব ট্রেনএত দূরত্বের কারণে গন্তব্য পৌঁছার সিডিউলও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল তখনএছাড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ির অতিউচ্চতা এবং গরমে অস্বস্তিবোধ করায় যাত্রীবান্ধব ট্রেনের তালিকায় নাম লেখাতে পারেনি ডেমুযার কারণে ডেমু ট্রেন ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েকখন, কোন সময়ে, কোন রুটে ডেমু দেখা যায় তা বলতে পারত না স্থানীয়রাওতাই যাত্রীদের আস্থাও অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।  ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা যেতকিন্তু উদ্বোধন পরবর্তী ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি যাত্রী নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে এসব ট্রেন বিভিন্ন বিভাগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেযার ফলে টানা দূরত্বে চলাচল করায় ত্রুটি দেখা দেয়

উল্লেখ্য, প্রতিসেট ডেমুতে সামনে-পেছনে দুটি ইঞ্জিনসহ তিনটি কোচ থাকেইঞ্জিন যেখানে আছে সেই কোচেও যাত্রী পরিবহন করা হয়২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেছিল বিগত সরকারএরপর ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম- দোহাজারী বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেট ট্রেন এবং বাকি দুই সেট পশ্চিমাঞ্চলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলএরমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ডেমু চলাচল বন্ধ হয় বহু আগেআর পূর্বাঞ্চলে গত বছরও ডেমু এক সেট মাঝেমধ্যে চললেও এখন পুরোপুরি বন্ধমূলত করোনা পরবর্তী ডেমু চলাচল অনিয়মিত হয়ে পড়ে

জানা গেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেটের মধ্যে ঢাকা বিভাগে শুধুমাত্র ঢাকা-টঙ্গী রুটে ১ সেট চলতঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ২ সেট বন্ধ দুই বছর, ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-জয়দেবপুর ও ঢাকা-টঙ্গী রুটেও প্রায় তিনবছরআখাউড়া-সিলেট এবং ময়মনসিংহ রুটে বন্ধ তিন বছরের বেশি সময়শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে ২ সেট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ সেট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে ১ সেট চালু ছিল ২০২২ সালে নিয়মিতসর্বশেষ নাজিরহাট ও বিশ^বিদ্যালয় রুটে চলাচল করলেও তাও এখন বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিনউল্লেখ্য, ২০১৩ সালে কেনা ডেমু ট্রেন সংস্কার করে চট্টগ্রামে ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম-দোহাজারী ও চট্টগ্রাম-পটিয়া রুটে চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেছিল সেসময়ের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনতখনো সেটি ছিল মূলত লোক দেখানোমূলত সাবেক দুই রেলমন্ত্রীর অদক্ষতার কারণেই ডেমুর এ অবস্থা উল্লেখ করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন এক প্রকৌশলী জানান, অতিরিক্ত দূরত্বের রুটে ডেমু চালু করেই এ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল তারাকিছু সরঞ্জাম সংস্কার করে কয়েকটি ট্রেন চলাচল করলেও বেশিরভাগ অকেজো ডেমু সচল করা যাবে নাএসব ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে কোচ পর্যন্ত সকল কিছুই সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত হয়যার কারণে চাইলেও যে মেরামত কিংবা খুলে যে কিছু করা যাবে নানষ্ট হয়ে পড়া ডেমু সচল করতে হলে চীন থেকে সরঞ্জাম আনার বিকল্প নেইকিন্তু এসব যন্ত্রাংশ না কিনে, মেরামত না করে এসি কোচ কেনা সম্ভব

আরও জানা গেছে, এসব ট্রেনে নারী ও বয়স্ক যাত্রীরা উঠত নাসিঁড়ি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উচ্চতা ছিল আড়াই ফুট, এই সমস্যার কারণে ওঠা-নামা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলএছাড়া এসব ট্রেনে বসামাত্র যাত্রীদের অত্যধিক গরমে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো

বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল ২০ সেট মিটারগেজ ডেমুচীনের সিএনআর তানসান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেড থেকে এসব কিনতে ব্যয় নির্ধারণ হয়েছিল ৪২৬ কোটি টাকা, পরবর্তীতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটিতেঅথচ ২৫ বছর আয়ুষ্কালের পরিবর্তে মাত্র ৫ থেকে ৭ বছরে এসব ট্রেন অকেজো হয়ে পড়ে২০২১ সাল পর্যন্ত ডেমু থেকে যে পরিমাণ আয় হয়েছে তার পুরো ব্যয় হয়েছে ট্রেন ব্যবস্থাপনায়উঠে আসেনি ব্যয় হওয়া রেলওয়ের টাকাওপূরণ হয়নি যাত্রীদের সেবার মানমূলত ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের যোগাযোগ সুবিধার জন্য ডেমু উপযোগীকিন্তু মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপিদের বাড়াবাড়িতে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বেও নিয়ে গেছে ডেমুমূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়েতখন ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে রেলওয়ে যে চুক্তি করে তার সঙ্গে ৩০ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ এবং আমদানির শুল্কসহ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকায়তবে যে স্বপ্ন নিয়ে এসব ডেমু কেনা হয়েছিল তা যাত্রীসেবা দিতে বঞ্চিত হয়

×