ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১

অপ্রাপ্তবয়স্করা চালাচ্ছে মোটরসাইকেল

হাইড্রোলিক হর্নে অতিষ্ঠ নগরবাসী

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

হাইড্রোলিক হর্নে অতিষ্ঠ নগরবাসী

.

একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর মোটরসাইকেল বা মোটরযান চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার কথা থাকলেও রাজধানীর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নঅলিগলিতে ১৪ থেকে ১৭ বছরের তরুণরা মোটরসাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অহরহশুধু তাই নয় উচ্চশব্দের হলার (এগজস্ট/সাইলেন্সার) ব্যবহার করে তৈরি করছে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণএর সঙ্গে বেড়েছে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের প্রবণতা

বিশেষ করে হাতিরঝিল, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, খিলগাঁওয়ের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার সড়কগুলোতে উচ্চশব্দের হলার লাগিয়ে তারা নগরবাসীর মধ্যে তৈরি করছেন আতঙ্কতাদের বাধা দিতে গেলে কেউ কেউ হচ্ছেন হামলার শিকারওমূল সড়কে নিয়ম ভেঙে মোটরসাইকেল চালালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা ধরনের শাস্তি, জরিমানা করলেও আবাসিক এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো এসব চালকদের যেন দেখার কেউ নেইদিন দিন তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে

রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় দেখা যায়, এসব মোটরসাইকেল চালকদের প্রায় সবাই নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীপূর্বে নগরীতে এমন মোডিফায়েড বাইকের সংখ্যা হাতেগোনা থাকলেও এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণবেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২ থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা দামের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাইকগুলোকে মোডিফাই করে পরিণত করা হচ্ছে এমন অস্বস্তিকর যানবাহনেযার বেপরোয়া চলাচলে সৃষ্ট উচ্চশব্দে এক রকম অতিষ্ঠ নগরীর পথচারীসহ অন্যান্য যান চালকরাশুধুমাত্র নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা আর শখেরবশে দামী মোটরবাইকের ক্ষতি করে উচ্চশব্দের বাইকে রূপান্তর করার কথা স্বীকার করেছে একাধিক কিশোরএজন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করছে

অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে শব্দ দূষণের ভয়ঙ্কর মাত্রায় থাকা নগরীতে  বাইকগুলো এখন চরম বিরক্তির যানবাহন, যা বাড়াচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিট্রাফিক আইন অনুযায়ী এটি দ-ণীয় অপরাধতাই এদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি সচেতন মহলেরএসব যানবাহন ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই কিশোর

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় এরকম হাইড্রোলিক হর্নের মাত্রাতিরিক্ত শব্দে বিরক্ত হয়ে দুই পথচারী প্রতিবাদ করলে তাদের প্রকাশ্যে কোপায় কয়েক কিশোর গ্যাং সদস্যএরপর থেকেই এসব হর্নের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছেন অনেকেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করছেন সমালোচনা

বুধবার নগরীর বাংলামোটর এলাকা থেকে ইয়ামাহা এমটি ব্র্যান্ডের একটি মোটরবাইকে হলার লাগিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায় এক কিশোরকেসে নিজেকে নগরীর একটি কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী বলে জানায়আকাশ নামের ওই কিশোর বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করায় তাকে পরিবার থেকে বাইকটি দেওয়া হয়েছেনিজের বাইকটিকে স্বতন্ত্র বানাতে মূলত হলারটি লাগিয়েছে ৮ হাজার টাকা খরচ করেঢাকায় তার বন্ধুদের দেখে এই  মোডিফাই করেছেএমন হলারের মূল্য ৫০ হাজার টাকার ওপরেও রয়েছেবর্তমানে এটি স্টাইল ও ট্রেন্ডনগরীর প্রায় সব মোটর মেকানিক এই মোডিফাই করতে পারেসে হলার লাগিয়েছে তবে অনেকেই উচ্চশব্দের মোডিফিকেশনের জন্য নিজেদের বাইকের সাইলেন্সার পাইপটি কেটেও ফেলেসিয়াম জানায়, সে যখন বাইক নিয়ে যায় অনেক সময় পথচারীরা গালাগাল করেতবে এতে তার কিছু যায়-আসে না বলে দাবি তার

দৈনিক অন্তত ১০ কিশোর হাইড্রোলিক হর্ন লাগাতে দোকানে আসেন জানিয়ে বাংলামোটরের ট্রাস্ট বাইক সেন্টারের মেকানিক নয়ন মাঝি বলেন, আমাদের তো এটা ব্যবসাকেউ এসব হর্ন লাগাতে এলে আমরা লাগিয়ে দেইকিন্তু এটি মানুষের বিরক্তির কারণ হতে পারে এটি বলে দেই

সন্ধ্যার পর থেকে এসব হর্নের কারণে বাসায় থাকা দায় উল্লেখ করে রাজধানীর মহানগর এলাকার বাসিন্দা অর্নব আহমেদ বলেন, হাতিরঝিলের লাগোয়া আমার বাসাসন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় এসব হাইড্রোলিক হর্নওয়ালা বাইকারদের অত্যাচারআমার ৩ বছরের বাচ্চা ভয়ে কান্না করে ওঠেকাকে এটি নিয়ে অভিযোগ করব, কি অভিযোগ করব কিছুই বুঝতে পারি না

একই এলাকার বাসিন্দা শিল্পী আক্তার কদিন থেকেই কানের সমস্যায় ভুগছেনবাম কানে গাড়ির হর্নের কোনো শব্দ শুনতে পারছেন নাগিয়েছিলেন তেজগাওয়ের জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটে ডাক্তার দেখাতেকিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার পর চিকিসক জানিয়েছেন প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত শব্দগ্রহণের কারণে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেচিকিসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল তবে আপাতত হেয়ারিং এইড মেশিন ব্যবহার করলে শুনতে পারবেনতারপর থেকেই হেয়ারিং এইড মেশিনই ব্যবহার করছেন তিনি

তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে নাক, কান, গলার চিকিসকের চেম্বারে দেখাতে এসেছেন গোলাম মওলা ও তার স্ত্রীকি হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, মূল সড়কের পাশেই বাড়িতাই সারাক্ষণই গাড়ির হর্ন, মানুষের চিকার চেঁচামেচিতে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়লেও উপায়ন্তর না দেখে ওখানেই বসবাস করছিলেনকিন্তু বিপত্তি বাধে সন্তানের জন্মের পর থেকেজন্মের তিন মাসের মাথায় বুঝতে পারেন কোনো শব্দে সে সাড়া দিচ্ছে নাএরপর থেকেই শুরু হয়েছে মেয়েকে সুস্থ করার যুদ্ধএই ডাক্তার, ওই ডাক্তার হয়ে কবিরাজের কাছে পর্যন্ত গিয়েছেন মেয়ের শ্রবণশক্তি ফেরাতেকিন্তু সবারই এক কথা গর্ভকালীন উচ্চমাত্রায় শব্দদূষণের কবলে পড়েছিল শিশুটিতার শ্রবণশক্তি ফিরতেও পারে নাও  পারে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দদূষণের ফলে রাজধানী ঢাকা এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছেএ দূষণের প্রধান উস বিভিন্ন যানবাহনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্নযা শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তিসহ বসবাসযোগ্য নগরী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিঅতিসত্বর এসব যানবাহনের শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে একটি বধির প্রজন্ম বেড়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে

শব্দ দূষণ বিষয়ে নাক, কান, গলা রোগ বিশেষজ্ঞ আবির্ভাব নাহা জনকণ্ঠকে বলেন, শব্দ দূষণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ভবিষ্য প্রজন্মের জন্য নিরাপদ শ্রবণ পরিবেশ তৈরির জন্য শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি বলব করতে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে প্রচার চালাতে হবেশব্দ দূষণ প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলোর এখতিয়ার নির্ধারণ এবং সারা দেশে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র এবং ইশারা ভাষা শিক্ষণ সহজলভ্য করাবিশেষ করে এসব হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে

একজন মানুষ যদি টানা ৮ ঘণ্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনে তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, শব্দদূষণ চোখ ও মাথার বিভিন্ন সমস্যার জন্যও দায়ীশহরের বেশিরভাগ মানুষই মাথার যন্ত্রণায় ভোগে, যার অন্যতম কারণ শব্দদূষণএছাড়া ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক এমনকি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারেঢাকা শহরে যেভাবে শব্দদূষণ বেড়ে চলেছে, তাতে এ শহরের অর্ধেক মানুষের শ্রবণক্ষমতা ৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছেএজন্য নিজের ও ভবিষ্য প্রজন্মের কথা চিন্তা করে শব্দ দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে

এদিকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাজরুরি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে কাজ করার আহ্বান সাধারণ মানুষেরএকটি বেসরকারি কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, রাস্তায় বের হলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠেতাই মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণহীন গতিবেগ ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াসহ উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী  জেনারেটর, হর্ন, যন্ত্রপাতি আমদানি ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবেবেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবেআবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার না করাবিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেম যেন শব্দের মাত্রা অতিক্রম না করে সে ব্যবস্থা করতে হবে

শব্দ দূষণকে নীরব ঘাতক আখ্যায়িত করে বিশেষজ্ঞ চিকিসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চ মাত্রায় শব্দ দূষণের কারণে স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা প্রতিনিয়তই হারিয়ে ফেলছে রাজধানীবাসীসড়কে হর্ন বাজানোর তীব্র প্রতিযোগিতা চলছেইমানুষের সহন ক্ষমতার দুই থেকে তিনগুণ শব্দের উপত্তি হচ্ছে এখানেইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও চলতে হচ্ছে অতিরিক্ত শব্দদূষণের মধ্য দিয়েফলে, নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে নগরবাসীএটি বন্ধে  সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে যে সরকারি ও  বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে হর্ন বাজবে নাএভাবেই সচেতনতা শুরু হবেএখনই শব্দের উচ্চমাত্রা কমানো না গেলে এই নীরব ঘাতক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মক্ষম মানুষকেও ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পরিণত করবে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা ০-২০ ডেসিবেল, মৃদু মাত্রা ২১-৪০ ডেসিবেল, মাঝারি/সহনীয় মাত্রা ৪১-৭০ ডেসিবেল, তীব্র মাত্রা ৭১-৯০ ডেসিবেল, অসহনীয় মাত্রা ৯১-১২০  ডেসিবেল

সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের শব্দ দূষণনিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে শব্দদূষণ নির্ধারিত মাত্রার  চেয়ে ১৩-৪০ ডেসিবেল  বেশিসবচেয়ে নীরব এলাকায় ৫০, আর শিল্প এলাকায় সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ থাকার কথাঅথচ পল্টন, ফার্মগেট, শ্যামলী, মগবাজার, গাবতলী, মিরপুরমোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডসহ ৭০টি এলাকাতেই শব্দের মাত্রা ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবেলের  বেশিফলে, মাথা ধরা, শারীরিক অবসাদ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শ্রবণশক্তি হ্রাসসহ ৩০টিরও অধিক কঠিন রোগের সৃষ্টি হয়এতে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি থাকে শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ করে হৃদরোগে আক্রান্তদের

×