
.
নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নতুন গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম বিআরটিসির সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা (আইসিডব্লিউএস)। আগামী জুনের মধ্যে ৪৫ সিটের দু’টি এসি যাত্রীবাহী বাস তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই পরিবহন সংস্থা। দরপত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র গাড়ির চেসিস (ইঞ্জিন) স্থানীয় মার্কেট থেকে ক্রয় করা হবে। গাড়ির বডি তৈরিসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় করা হবে। এতে প্রতিটি গাড়ি তৈরিতে এক কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এছাড়া এই মেরামত কারখানায় প্রায় ৩৪ লাখ টাকার রাবার বেলোজ মাত্র ৪১ হাজার টাকা ব্যয়ে স্থানীয় মার্কেট থেকে সংগ্রহ করে আর্টিকুলেটেড বাস সচল করা হয়েছে বলে বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের জুনে চালু করা হয় বিআরটিসির সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা (আইসিডব্লিউএস)। বিশাল জায়গা নিয়ে এত উন্নতমানের কারখানা বাংলাদেশে আর নেই। আগে এই কারখানায় বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করানো হত। এখন আর তা নেই। এখানে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে উন্নতমানের টায়ার রিট্রেড প্লান্ট। এছাড়া আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গাড়ি মেরামত করা হয়। এই কারখানাটি চালুর পর আমরা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করি। তা হলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাড়ি তৈরি সক্ষমতা। ইতোমধ্যে দু’টি এসি বাস তৈরির চেসিস ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে গাড়ি দু’টি তৈরির কাজ শুরু হবে। সকল প্রস্তুতি শেষ। এক মাসের মধ্যে দু’টি গাড়ি তৈরি করা সম্ভব। চেসিসসহ প্রতিটি গাড়ি তৈরি করতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা।’ আগে যেখানে এক একটি গাড়ি আমদানি করতে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হতো। এখন সেখানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন গাড়ি তৈরি করতে বিআরটিসি সক্ষম বলে জানান তিনি।
বিআরটিসির সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও জাপান যৌথ উদ্যোগে জাইকার তত্ত্বাবধানে ১৯৮১ সালে ১৬ দশমিক ৬ একর জমি নিয়ে বিআরটিসি সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা (আইসিডব্লিউএস) গাজীপুরে স্থাপিত হয়। ২০০০ সালের পর থেকে কারখানাটিতে গাড়ি মেরামত কাজ কমতে থাকে। ২০১২ সালে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। আট বছর পর ২০২১ সালের জুনে কারখানা পুনর্সংস্কারের মাধ্যমে হালকা ও ভারি মেরামত কার্যক্রম শুরু করেন বিআরটিসির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম। কারখানার পুরাতন ওয়ার্কশপ শেড, প্রধান ফটক ও ইয়ার্ড জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল যা বর্তমানে সংস্কার করে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সালে কারখানা চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত মোট ১১৩টি গাড়ির ভারি মেরামত কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ১০টি গাড়ির ভারি মেরামত কাজ চলছে।
এছাড়া এই কারখানা থেকে বাংলাদেশ সাফ জয়ী নারী ফুটবলারদের স্বাগত জানানোর জন্য মাত্র এক রাতে ছাদ খোলা বাস তৈরি করে তাদের স্বাগত জানানো হয়। শিক্ষার আলো সকলের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে বিআরটিসি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি তৈরি করা হয়। কক্সবাজারে পর্যটকদের জন্য ছাদ খোলা পর্যটন বাস তৈরি করা হয় যা পর্যটকদের ভ্রমণের প্রতি আরও উৎসাহিত করে। বিমান বন্দরের প্রবাসীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় এনে প্রবাসীদের সুবিধায় বিমান বন্দরে বিশেষ শাটল বাস তৈরি করা হয়েছে। তাই নিজস্ব সক্ষমতায় এই কারখানা থেকেই নতুন দুটি যাত্রীবাহী এসি বাস তৈরি কাজ করা হচ্ছে বলে বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) মেজর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিআরটিসি’র নিজস্ব মেরামত কারখানা থেকে দু’টি এসি যাত্রীবাহী বাস নির্মাণে কাজ করা হচ্ছে। বাস দু’টি হবে ৪৫ সিটের। বাসের শুধু চেসিস (ইঞ্জিন) দরপত্রের মাধ্যমে স্থানীয় মার্কেট থেকে ক্রয় করা হবে। বাকি সব কাজ এই কারখানা থেকে করা হবে। প্রথমদিকে বাসের বডি তৈরি করতে কিছুটা সময় লাগবে। পরবর্তীতে প্রতিমাসে চারটি করে গাড়ি তৈরি করা যাবে এখানে।’
সচল হয় পরিত্যক্ত আর্টিকুলেটেড বাস ॥ বিআরটিসির সূত্র জানায়, যানজটের নগরীতে এক বাসে বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে, এমন যুক্তিতে ২০১৩ সালে ঢাকায় জোড়া লাগানো (আর্টিকুলেটেড) বাস নামানো হয়। শুল্ক ও কর বাদ দিয়ে ভারত থেকে কেনা এসব বাসের প্রতিটির দাম পড়ে ৮৪ লাখ টাকা। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যে বেশিরভাগ বাস লক্কড়ঝক্কড় হয়ে যায়। ৮ বছরের মাথায় এখন ৫০টির মধ্যে ১৫টি জোড়া লাগানো বাস অচল হয়ে পড়ে থাকে গাজীপুরে বিআরটিসির কারখানায়। জোড়া লাগানো প্রতিটি বাসে আসনসংখ্যা ছিল ৫৮টি। কেনার সময় বলা হয়েছিল, প্রতিটি বাস গড়ে প্রতি যাত্রায় ১৩০ জন যাত্রী বহন করতে পারবে। শুরুতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পথে এসব জোড়া লাগানো বাস চলতে দেখা যায়। কিন্তু এখন আর ঢাকায় এসব বাস খুব একটা দেখা যায় না। শুধুমাত্র কুড়িল-ভুলতা সড়কে কিছু বাস চলাচল করছে।
৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মধ্যে মাত্র ৭টি বাস সচল ছিল। বর্তমানে সচল বাসের সংখ্যা ২৭টিতে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। আরও ৮টি আর্টিকুলেটেড বাস সচল করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। চলমান বাসগুলো মেরামত করে ঠিক রাখা হলেও বাসে জার্মানিতে তৈরিকৃত রাবার বেলোজ স্থানীয় মার্কেটে না পাওয়ায় মেরামত করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। রাবার বেলোজ মূলত বাসের দুটি অংশকে যুক্ত রাখে এবং ডানে-বামে চলাচলের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এমনকি নতুন সংযোজনের ক্ষেত্রেও প্রতিটি বাসের রাবার বেলোজের মূল্য ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ২৫ টাকা হলেও বাংলাদেশের স্থানীয় মার্কেটে স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যাচ্ছিল না। সে পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা, গাজীপুরের কারিগরি বিভাগ টিম হিসেবে কাজ করে সাশ্রয়ী মূল্যে ১টি রাবার বেলোজ প্রস্তুত করে। এটি প্রস্তুত করতে মাত্র ৪০ হাজার ৬৯৯ টাকা ব্যয় হয়। এভাবে এই আর্টিকুলেটেড বাস সচল করা হয় বলে বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আর্টিকুলেটেড বাস সচল করতে প্রধান সমস্যা ছিল রাবার বেলোজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এটা জার্মানি থেকে আনতে খরচ হবে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। তাই আমরা গাজীপুরে কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে একটি কারিগরি টিম তৈরি করি। তারা পরিশ্রম করে ১টি রাবার বেলোজ প্রস্তুত করে। এটি তৈরি করতে প্রায় ৪১ হাজার টাকা খরচ হয়। এই রাবার বেলোজ দিয়ে ২৭টি গাড়ি সচল করা হয়েছে। এই গাড়িগুলো এখন কুড়িল থেকে পূর্বাচল সড়ক ভুলতা পর্যন্ত চলাচল করে।’ বিআরটিসির নিজস্ব কারিগরি টিম থাকার কারণে এটা সম্ভাব্য হয়েছে বলে জানান তিনি।
বেসরকারি গাড়িও মেরামতের পরিকল্পনা ॥ বিআরটিসির সূত্র জানায়, সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ২৫ জন কারিগর রয়েছে যাদের দ্বারা হালকা ও ভারি সকল ধরনের মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। অত্র প্রতিষ্ঠানে অযত্নে পরে থাকা লেদ মেশিন, সেফার মেশিন, রেডিয়াল ড্রিল মেশিন, স-মেশিন, ভাল্ব গ্রাইন্ডিং, মিলিং মেশিন, হাইড্রলিক প্রেস পাওয়ার, ওয়াশিং স্ট্যান্ড, ব্রেক সু গ্রাইন্ডার, ব্রেক ড্রাম লেদ, পাওয়ার রিভিটার, সেল্ফস্টার্টার টেস্টার, কমুটেটর কাটার লেদ, টিউভ ছলিসন হিটার ইত্যাদি পুনরায় মেরামত করে নতুন করে মেরামত কাজ শুরু করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানে যে সকল প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের আর কোনো বাস কোম্পানিতে নেই।
এই মেরামত কারখানায় কারিগরদের নিরাপত্তার জন্য সেফটি-সু পোশাক, হ্যান্ড গ্লোবস, গগলস ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। কারিগরদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ফাস্ট এইড বক্স রয়েছে যার ফলে কারিগরদের সকল প্রকার প্রাথমিক চিকিৎসা এখানেই করা সম্ভব হয়ে থাকে। কারিগরদের কর্মে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্রদান করা হয় যেমন-বিশ্রামাগার, নাস্তা, সুপেয় পানি, শ্রান্তি বিনোদনসহ বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়। এই কারখানায় সকল প্রকার সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নশিপ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এখানে বিআরটিসির নিজস্ব পরিবহন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি পরিবহন মেরামত করা হয় বলে কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার (আইসিডব্লিউএস ও প্রশিক্ষণ) প্রকৌশলী ফাতেমা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, গাজীপুরে কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানার মাধ্যমে বর্তমানে চার শতাধিক কারিগরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে আসা ছাত্রদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এখানে সকল প্রকার সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নশিপ করানো হয়। সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের বিভিন্ন ডিপো হতে আসা কারিগরদের ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশন, বডি, ওয়েলডিং, গ্লাস খোলা-ফিটিং, পেইন্টিং এবং এসি সিস্টেম ও অটো-ইলেকট্রিক সিস্টেমের ওপর প্রশিক্ষণ করানো হয়।’ এই কারখানায় বিআরটিসির নিজস্ব পরিবহন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন মেরামত করা হয় বলে জানান তিনি।
৬ বছর পর চালু হয় টায়ার রিট্রেড প্লান্ট ॥ বিআরটিসির সূত্র জানায়, সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় টায়ার রিট্রেড প্লান্টটি নানান জটিলতার কারণে ২০১৮ সালে বন্ধ হয়। এটি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে পুনরায় চালু করা হয়। এরপর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২টি টায়ার রিট্রেডিং করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত টায়ার রিট্রেড প্লান্টে মোট ৪১৬টি টায়ার রিট্রেড সম্পন্ন করা হয়। এতে করে করপোরেশনের ব্যয় হ্রাস হচ্ছে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি টায়ার রিট্রেড করার ফলে প্রায় ৩০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত চলাচল করা যায় বলে কর্মকর্তারা জানান।
প্রকৌশলী ফাতেমা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রশিক্ষক রয়েছেন যারা অত্র ইউনিটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত মোট ১৬ জন কারিগরকে নিয়ে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রেডভিত্তিক (ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশন সিস্টেম, এসি ও অটো ইলেক্ট্রিক সিস্টেম ও বডি ডেন্টিং, পেইন্টিং সিস্টেম ইত্যাদি) প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয় এবং এ পর্যন্ত ৪১৬ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।