
.
জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এনে দিতে আমাদের অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। মাতৃভাষার জন্য জীবনদানের এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
শুক্রবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৫’ উপলক্ষে চারদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, বাংলাদেশে ইউনেস্কো প্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি সুসান ভিজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে দেশের কিছু দেওয়ার নেই, সে দেশের ভাষাতেও পৃথিবীর আগ্রহ নেই অথবা থাকলেও নিম্ন পর্যায়ে থাকবে। প্রযুক্তি ছাড়াও যে কোনো দিক থেকে একটি জাতি নেতৃত্ব দিতে পারলে, সে দেশের ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বেই, সে ভাষা যত জটিলই হোক না কেন। জাতি এগিয়ে গেলে ভাষাও এগিয়ে যায়, ভাষার সম্মান বাড়ে। নিজ ভাষার নিবেদিতপ্রাণ প্রচারকর্মী হওয়া সত্ত্বেও জাতির কাছ থেকে পৃথিবীর ভাণ্ডারে কিছু দেওয়ার না থাকলে, ভাষার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
মাতৃভাষা দিবসে সব মাতৃভাষা সংরক্ষণের প্রতিজ্ঞা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এর পেছনে আবেগের কারণ তো আছেই, মস্ত বড় স্বার্থের কারণও আছে। এখন আমাদের জানা নেই কোন্ অজ্ঞাত নামহীন মাতৃভাষা পৃথিবীকে সম্পূর্ণ বদলে দেবে। কোনো সম্ভাবনাকে অবজ্ঞা করলে মস্ত বড় ভুল করব।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা আজ পদক পেয়েছেন, তাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য যারা অলিম্পিয়াডে পুরস্কার পেয়েছেন, তাদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ এ আন্দোলন বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য সূচিত হলেও এর মূল চেতনাটি ছিল স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তা ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন, তাই বাঙালির কাছে একুশ মানে মাথানত না করার দৃঢ় প্রত্যয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বেদনার্ত অতীতকে স্মরণ করে অশ্রুবিসর্জনের দিন নয়, বরং এক অবিনাশী প্রেরণা, সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র।’
অনুষ্ঠানে তিন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে এবারের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে ভূমিকা রাখায় এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক পেয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষা গবেষক অধ্যাপক আবুল মনসুর মুহম্মদ আবু মুসা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের রচনাবলি অনুবাদ, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ এবং প্রসারে ভূমিকা রাখায় ব্রিটিশ কবি জোসেফ ডেভিড উইন্টারকে এ পদক দেওয়া হয়েছে।
বাঙালির ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক পেয়েছে প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাসের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে পদক নেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
পদক হিসেবে ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, সম্মাননাপত্র এবং চার লাখ টাকা কিংবা সমমূল্যের ডলার দেওয়া হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানে লিঙ্গুইস্টিক অলিম্পিয়াড বিজয়ীদেরও সনদপত্র দেওয়া হয়।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এনে দিতে আমাদের অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, মাতৃভাষার জন্য জীবনদানের এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃভাষার চেতনা ও মর্যাদা রক্ষার প্রেরণা ও এ চেতনার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার সূত্রে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। বিশ্বের সকল মাতৃভাষার সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও গবেষণার ইতিবৃত্তকে লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার যাত্রা শুরু করে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মাতৃভাষা যে কোনো নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বাহক। মাতৃভাষার সঙ্গে সব মানুষের আত্মার সম্পর্ক। মাতৃভাষার পর মানুষ যত ভাষাই আত্মস্থ করুক না কেন, সেসব নতুন ভাষায় যতই পারদর্শিতা অর্জনই করুক না কেন, মাতৃভাষাকে তার হৃদয়ের গভীরতা থেকে সরাতে পারে না।’
এ সময় বিভিন্ন ভাষা শেখাতেও উৎসাহ দেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘একটি নতুন ভাষা শিখলেই পুরানো ভাষায় দুর্বল হয়ে পড়বে এই ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। পৃথিবীর বহু দেশে একই নাগরিক সাবলীলভাবে কয়েকটি ভাষায় কথা বলবে, এটা খুবই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা শৈশব থেকে নানা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্কুলে পড়ার সময় প্রত্যেক ছাত্রকে অন্তত একটি ভিন্ন ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্ররাও আনন্দ সহকারে সেটা করে থাকে। ইংরেজি শিখলেই বাংলা ভুলে যেতে হবে, এরকম কোনো চিন্তা তাদের কারও মাথায় আসে না।’
যে দেশের প্রযুক্তি পৃথিবীতে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে, তার সঙ্গে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে প্রযুক্তিদাতা দেশের ভাষা, সারা পৃথিবী এই ভাষা শেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘যে দেশ পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে পৃথিবী সে দেশের ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়বে- এটাই নিয়ম।’
মাতৃভাষার গুরুত্ব না বুঝলে এসডিজি অর্জিত হবে না ॥ মাতৃভাষার গুরুত্ব না বুঝলে এসডিজি অর্জিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তী পালন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানুষের পরিচয়ের মূলেই রয়েছে মাতৃভাষা। সকলকে নিজের মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে হবে। অন্যথায় থ্রি জিরো তত্ত্ব ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে না। কারণ কাউকে পেছনে রেখে এগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না।
তিনি বলেন, মাতৃভাষাতেই অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তির যথার্থ প্রকাশ হয়। জুলাই অভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশ নির্মাণের ইতিহাসে মাতৃভাষার বহির্প্রকাশ রয়েছে। ভাষায় জাতিগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকে। এর ফলেই জাতিগুলোর মধ্যে এত বৈচিত্র্য দেখা যায়।
ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে হলে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। ব্যক্তি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে একটি ভাষাকেও বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না। এ সময় ইউনেস্কো পৃথিবীর প্রতিটি মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও প্রসারে ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।