
.
অমর একুশের অবিনাশী চেতনাকে উপলব্ধিতে নিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে এবং ইতিহাস-সচেতন আত্মমর্যাদাশীল সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথে শুক্রবার দেশব্যাপী পালিত হলো মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এবারও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনে শোক ও আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল ভাই হারানোর বেদনা, অন্যদিকে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরব। দুই অনুভূতিই নতুন করে আন্দোলিত করেছে বাঙালিকে। এদিন শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পাশাপাশি নিজ জাতিসত্তা, ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি রক্ষার শপথ নিয়েছে দেশের মানুষ। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে দিবসের সূচনা হয়। বরকত রফিক সালাম জব্বারদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সারাদেশে অর্ধনমিত রাখা হয় জাতীয় পতাকা। লাল সবুজের পতাকার পাশাপাশি ওড়ানো হয় কালো পতাকাও। অনেকে বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই নানা বঞ্চনার শিকার হতে থাকে বাঙালি। সবার আগে আঘাত আসে ভাষার ওপর। পাকিস্তানিরা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে এ অঞ্চলের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। দুঃখে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা। তীব্র হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে বাংলা মায়ের সাহসী সন্তানেরা। ওই মিছিলে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গুলি চালালে রক্তে ভেসে যায় ঢাকার রাজপথ। তবে এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। রক্ত দিয়ে হলেও বাঙালি তার ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। গৌরবময় ইতিহাস স্মরণেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবারও রাজধানীসহ সারাদেশে নানা আনুষ্ঠানিকতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে দিবসটি পালিত হয়েছে।
যথারীতি একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এর পর পরই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে ভাষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা। পরে প্রধান বিচারপতি, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একে একে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সাংস্কৃতিক সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও ফুল দেওয়া হয় শহীদ মিনারে। এবার অবশ্য উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। রাত শেষে সকালে বিচ্ছিন্নভাবে ফুল দিতে এসেছিলেন অনেকে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আসা মানুষের হাতে ছিল ফুলের তোড়া। কেউ কেউ সন্তান বা স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। একদিকে চলেছে ফুল দেওয়া, অন্যদিকে সেই ফুলে সাজতে থাকে শহীদ মিনারের বেদী। অর্ঘের ফুলে শহীদ মিনারকে সাজিয়ে নেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
এদিন নারী পুরুষ শিশুদের অনেকেই শোকের কালো রঙে সেজে এসেছিলেন। তাদের পোশাকে কালোর পাশাপাশি ছিল সাদা রঙের মিশেল। শাড়ি পাঞ্জাবি শার্ট যে যাই গায়ে দিয়ে বের হয়েছেন, রং বেছে নেওয়ার দিক থেকে মিল ছিল তাদের মধ্যে।
প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা মানুষের স্রোত সরাসরি বাংলা একাডেমির বইমেলায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। সে অনুযায়ী এদিন সকাল সাড়ে ৭টায় খুলে দেওয়া হয়েছিল অমর একুশে বইমেলার প্রবেশদ্বার। তবে দিনের প্রথম ভাগে বইমেলায় লোকসমাগম ছিল খুবই কম। দুপুর পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তেমন আনাগোনা চোখে পড়েনি। স্টল প্যাভিলিয়ন খোলা রাখলেও, প্রকাশকরা হতাশই হয়েছেন। অবশ্য বিকেলের দিকে মেলায় লোক সমাগম বাড়তে থাকে।
একুশের অনুষ্ঠানমালা ॥ এদিন রাজধানীর কয়েকটি মঞ্চে অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়। সংগীত কবিতা নৃত্যায়োজনসহ নানা পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় ভাষা শহীদদের প্রতি। সন্ধ্যায় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে এদিন একুশের স্মৃতিচারণ করা হয়। ছিল একক ও সম্মেলক গান এবং দলীয় আবৃত্তি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিকেলে ছিল একই ধরনের আয়োজন। অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষাসহ বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার কবিতা পাঠ, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করা হয়। বাংলা অনুবাদসহ নিজ ভাষায় কবিতা পাঠ করেন বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার মানুষেরা। সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করে ‘কালার অব হিলস্’ ও ‘গারো কালচারাল একাডেমি’ নামের দুটি সংগঠন।
শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে ছিল ‘একুশের নিবেদন।’ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় দেশাত্মবোধক যন্ত্রসংগীত দিয়ে। কণ্ঠসংগীত নৃত্যায়োজনেও ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হয়।
ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় ‘বর্ণমেলা’। সকাল থেকেই শিশু সন্তানদের নিয়ে মেলায় ভিড় করেন অভিভাবকরা। গান, আবৃত্তির মতো নানা আয়োজনের পাশাপাশি বর্ণমেলায় গ্রামবাংলার বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়।
একই রকম নানা আয়োজনে ঢাকার বাইরেও পালিত হয় অমর একুশে।