ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

গণভবনে গণতন্ত্র নয়, শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ছাপ এখনো স্পষ্ট

প্রকাশিত: ০২:০৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০২:১৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গণভবনে গণতন্ত্র নয়, শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ছাপ এখনো স্পষ্ট

ছবি : জনকণ্ঠ

ছয় মাসে অনেক কিছু বদলেছে বাংলাদেশে। কিন্তু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বাসস্থান গণভবনে যেন সময় থমকে আছে।

সেই ঐতিহাসিক ৫ই আগস্টে যেদিন জনতা ক্ষমতা নিয়ে নেয়, জনগণের এই ভবনের।

ঘুটঘুটে কালো করিডোর, জানলা দিয়ে আসা সকালের রোদে আলোকিত ঘর। এলোপাতারি পড়ে থাকা আসবাবপত্র, মেঝেতে কার্পেটের মতন ছেয়ে থাকা ভাঙ্গা কাচ। আর শত শত মোচড়ানো গোপন নথি, কি পেলাম আমরা পলাতক স্বৈরশাসকের বাসস্থানে!

গত ১০ বছর ধরে অনেক গণমাধ্যম নিষিদ্ধ ছিল গণভবনের সংবাদ সম্মেলন গুলোতে। অথচ আজকে আমরা কি অবলীলায় ঢুকে পড়লাম হাসিনার শোবার ঘর পর্যন্ত। প্রতিটি ঘরে এখনো অনেক অনেক দলিল। যেমন, জুলাই-আগস্ট মুভমেন্টের সময় তৈরি এই নথিতে দেখা যায়, আন্দোলন দমাতে কি কি পদক্ষেপ হাসিনা বিবেচনায় নিয়েছিলেন।

নথিতে দেখা যায়, হাসিনার প্ল্যান ছিল ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে ব্যবস্থা নেয়া। আমরা জানি, জুলাই মাসের শেষে ছাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আর আসিফ মাহমুদসহ ছয় জনকে জোরপূর্বক ডিবি কার্যালয়ে আটক রাখা হয়েছিল। একই সাথে হাসিনাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল গণগ্রেফতার হওয়া সকল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারিক ব্যবস্থা নিতে।

নথিতে এও দেখা যাচ্ছে যে, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল আকবর হোসেন, যিনি ডিজিএফআই এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল, ওনাকে আন্দোলন দমানোর দায়িত্ব দেয়ার কথা বলা আছে। গত মাসে আকবরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। নথিতে এও বলা ছিল যে, ফেসবুকে নজরদারী বাড়াতে হবে এবং একই সাথে সরকারের জন্য আপত্তিকর কন্টেন্ট সরাতে হবে।

আরেকটা প্ল্যান ছিল, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা। যারা আন্দোলনকে স্পন্সর করার জন্য টাকা নিয়ে আসছিলেন দেশে।

আরেক নথিতে দেখা যাচ্ছে, কাদের উপর সরকার নাশকতা করার সন্দেহে নজরদারী করছিল। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ আর ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে গোপনীয়তার সাথে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করার পরামর্শ দেয়া হয় এ নথিতে। এখানে আরো ছিল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল উত্তরা শাখার নাম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তারা বিনামূল্যে আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমরা হাসিনার বেডরুমে একটা প্রিন্ট আউট পাই। যেখানে লেখা ছিল, কোরআন এবং হাদিসে মানুষ খুন নিয়ে কি বলা আছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ মানুষ শহীদ হয়।

আওয়ামী লীগ পার্টির অনেক অনেক নথি ছিল গণভবনে। একটা নথি পেলাম যেখানে হিসাব রাখা হচ্ছিল, কোন এমপি-মন্ত্রী কত টাকা দিচ্ছে পার্টি ফান্ডে। যেরকম প্রাক্তন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম দিয়েছেন ৫০ লক্ষ টাকা, এমপি কামরুল ইসলাম দিয়েছেন ২০ লক্ষ টাকা, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী, উনি দিয়েছিলেন এককালীন ১ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা।

একই সাথে ২৮ জন সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপিরা দিয়েছিলেন আড়াই কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ঘরে পড়ে থাকা নথিগুলো দেখে আমরা যেটা বুঝতে পারি, সেটা হচ্ছে যে, সে বিএনপিকে নিয়ে এক প্রকার অবসেস ছিল। অসংখ্য নথি পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা গেছে যে, বিএনপির উপরে কি পরিমাণ নজরদারী করতো শেখ হাসিনা। বিএনপির আমলের সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন নিয়ে অনেক কাগজ ছিল তার রুমে।

আরো ছিল, ২০১৩-১৪ তে ঘটে যাওয়া পেট্রোল বোমা সহিংসতায় ভিকটিমদের তথ্য। ২০১৩ সালের বিএনপির ডাকা ব্লকেট কিভাবে প্রতিহত করতে হবে, সেরকম একটা গোয়েন্দা প্রতিবেদনও ছিল।

যদিও আমরা জানিনা কোন ঘরগুলো কার ছিল, কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা ডকুমেন্টস থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। যেমন পুতুলের ঘর ছেয়েছিল অটিজম সংক্রান্ত কাগজে। জয়ের ঘরে ছিল, তার ফেলে যাওয়া একটা শার্ট এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে অনেক নথি।

আমরা গণভবনের মেডিকেল সেন্টারে হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার অসংখ্য মেডিকেল রেকর্ড পাই। কিন্তু দুটো কাগজ আমাদের চোখে ধরে। দুটো কোভিড অ্যান্টিবডি টেস্ট, যার দুটোই পজিটিভ রেজাল্ট। হাসিনা কি তাহলে কোভিড হয়েছিল!

তবে একটা কথা এখানে বলতেই হবে, হাসিনা তার মৃত্যু নিয়ে এক প্রকার প্যারানয়েড ছিলেন। যেরকম হাসিনা তার পানির সাপ্লাই সময় সময় রাসায়নিক টেস্ট করাতেন। তার বাসস্থানের প্রতিটি দেয়াল ছিল বুলেটপ্রুফ। এমনকি তিনি গণভবনে উঠেনও কি কিন্তু নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে।

২০০১ সালে তিনি আইন পাশ করেন, যেটা দ্বারা মুজিব পরিবার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পাওয়ার এখতিয়ার পায়। এই মোতাবেক হাসিনা এক টাকায় গণভবন লিজ নেন। নথিগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, সরকারি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ভবন। এখান থেকে নেওয়া হতো সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

যা গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন ডিটারমাইন করেছিল। একদিন এই ভবনের ভাঙ্গা কাচ, ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে তৈরি করা হবে, ঝকঝকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর।

কিন্তু আপাতত এই ভবন সাক্ষ্য দিচ্ছে, গণবিরোধী একটি সরকারের পরিণতি কি হতে পারে।

 

সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=2mZOLlQvCi8

মো. মহিউদ্দিন

সম্পর্কিত বিষয়:

×