
আগে নির্বাচন চায় বিএনপি
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কবে। এ নিয়ে চলছে রাজনীতির আলোচনা তুঙ্গে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন দিতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করছে। সভা সেমিনারে বক্তব্যের মাধ্যমে তারা প্রতিদিনই দলের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি ডেডলাইন দিয়েছেন।
এক ভাষণে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে চব্বিশের গণহত্যার বিচার কতদূর এগোবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। দুই হাজার শহীদ পরিবার, অর্ধলক্ষ আহত এবং হাসিনা সরকারের পতনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের বড় অংশ বলছে, বর্তমান সরকারের অনেক কাজের মধ্যে প্রধান কাজ হচ্ছে, চব্বিশের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা।
ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই সরকার গঠন হয়েছে। তারা যদি গণহত্যার বিচার নিশ্চিত না করে নির্বাচন দিয়ে দেন তাহলে শহীদ পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং পুরো জাতির কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। বিচারের আগে নির্বাচন হলে এই সরকার ব্যর্থ হবে বলেও জানানো হচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, নির্বাচনটা হওয়া দ্রুত দরকার, চলতি বছরেই নির্বাচন সম্ভব। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হোক। ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
যৌক্তিক সংস্কারের পর যে কোনো সময় নির্বাচন হতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘জুলাই চার্টারের’ ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে, সেটাতে সবাই অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো সই করবে। স্বাক্ষর করা সেই ডকুমেন্টটা হবে জুলাই চার্টার। আর জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করবে আমাদের নির্বাচনটা কবে হবে।
শহীদ পরিবার ও ছাত্র-জনতার বড় অংশ বলছেন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে হাসিনা সরকারের বিদায় হয়নি। রাজনৈতিক আন্দোলন করে বিএনপি ১৭ বছরে খালেদা জিয়ার মুক্তি, গুম, খুন ও তারেক রহমানকে দেশে ফেরাতে পারেনি। আবার জামায়াতে ইসলামীও আন্দোলন করে তাদের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি থেকে বাঁচাতে পারেনি।
সকলের অংশগ্রহণে হাসিনার পতন হয়েছে। তাই রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন পরিস্থিতিতে এই সরকারকে সর্ব অবস্থায় শহীদ পরিবার এবং শিক্ষার্থীদের দাবির দিকে লক্ষ্য রাখতে কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের রোডম্যাপের বার্তার ইঙ্গিত পেয়ে শহীদ পরিবারের বড় একটি অংশ থেকে তিন শব্দে একটি দাবি তুলেছেন। তা হলো , ‘বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচন’। সংস্কার এবং নির্বাচনের পূর্বে অবশ্যই দুই হাজার শহীদের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সরকার যদি বিচারের আগে কোনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দেয়, তাহলে শহীদ পরিবার রাস্তায় নামবে বলেও হুঁশিয়ারি ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে শহীদ এবং আহত পরিবারের আলাদা জোট গঠন করা হয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং শাহবাগে আলাদা কর্মসূচি পালন করে সন্তান হত্যা, স্বামী হত্যা, ভাই হত্যার বিচার চেয়েছেন।
যদি বিচার নিশ্চিত করতে শহীদ পরিবারকে রাস্তায় নামতে হয়, তাহলে এটা হবে এই সরকারের বড় লজ্জা বলেও ছাত্রদের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। যে তিন দাবির কথা শহীদ পরিবার জানাচ্ছেন তার সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সকল শিক্ষার্থী একমত। প্রয়োজনে বিচার নিশ্চিতে তারা নামবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
দেশের চলমান নির্বাচনের এমন প্রসঙ্গ নিয়ে জানতে চাইলে উত্তরায় গুলিতে ছয় বছরের শিশু শহীদ জাবের ইব্রাহিমের মা রোকেয়া বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু আমার জাবির না আমি সকল সন্তান হত্যার বিচার চাই। আমার ছয় বছরের বাচ্চাকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমার সন্তানের সকল রক্ত এই জমিনে পড়েছে। শত চেষ্টা করেও কেউ আমার জাবিরের রক্ত বন্ধ করতে পারেনি।
শুধু আমার ছেলে নয় এভাবে ওরা শত শত হাজার মানুষকে মেরে ফেলছে। ওরা নেট বন্ধ করে জাহাঙ্গীর নগরে কয়েকটা বাচ্চাকে আইডি কার্ডসহ কবর দিয়ে ফেলছে। ভ্যানের মধ্যে স্তূপ করে অনেক বাচ্চাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলছে। একজন খুনিও যাতে ছাড়া না পায় আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই। আগে ওদের বিচার হবে তারপর একটা নির্বাচন হোক।
আমরা চাই না আমার সন্তান হত্যার বিচারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হোক। আমি আমার সন্তান এবং সকল সন্তানের হত্যার বিচার নির্বাচনের আগেই চাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে চাই। জীবন্ত অবস্থায় সন্তান হত্যার বিচার দেখে চাই।
শহীদ শেখ ফাহমিন জাফরের মা কাজী লুলুন মাকমিন জনকণ্ঠকে বলেন,আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। কেন এতদিন লাগছে তাদের ফাঁসিতে ঝুলাতে। তারা প্রকাশ্যে দিবালোকে ঘোষণা দিয়ে আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। তাদের ঝুলাতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগার কথা। কেন এত সময় লাগছে ? আমার সন্তান নির্বাচনের জন্য জীবন দেয়নি।
যারাই ক্ষমতায় আসুক, তার আগে যেন আমার সন্তান হত্যার বিচার নিশ্চিত হয়। শহীদ জাহিদুজ্জামানের মা বিলকিস জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বিচার পেলেও আমাদের কলিজার ক্ষত শুকাবে না। তবে বিচার পেলে হয়ত আমাদের অন্তর কিছুটা হলেও শান্ত হবে। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। তা যেন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই করা হয় আমি এই সরকারের কাছে আহ্বান জানাব।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম জনকণ্ঠকে বলেন, হাসিনাকে সরাতে আমাদের হাজারের অধিক ভাই-বোন শহীদ হয়েছেন যাদের তথ্য আমরা এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে পেয়েছি এই সংখ্যা আরও বড় হবে। এছাড়া অর্ধ লক্ষ মানুষ আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
হাসিনাসহ যে সকল এমপি মন্ত্রীদের নির্দেশে এই গণহত্যা হয়েছে, তাদেরকে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়বদ্ধতা সবকিছুর আগে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা। শহীদদের রক্তের ওপর এই সরকার গঠন হয়েছে। এই সরকারের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় সেভাবে এগোয়নি।
এই অন্তর্বর্তী সরকার যতদিন থাকুক না কেন, নির্বাচনের পূর্বে অবশ্যই এই সরকারকে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করে যেতে হবে। সরকার যদি নির্বাচন দিতেই চায় অবশ্যই তার আগে ছাত্র-জনতার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এটা যদি না করতে পারে, তাহলে এটা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এটা যদি সরকার করে যেতে না পারে, সকল শহীদ পরিবার, আহত এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজীবন দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিৎ ছিল গণহত্যার বিচার। যারা গণহত্যায় জড়িত, তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা। সারা বাংলাদেশের মানুষ বিচার দেখার অপেক্ষায় আছে আমরাও আছি। যত দ্রুত হওয়া উচিৎ ছিল সেটা হচ্ছে না। আমি আশা রাখছি এই সরকার খুব দ্রুত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করবে।
এই সরকারের এটাই মূল কাজ। আলাদা ট্রাইব্যুনালে চব্বিশের জুলাইয়ে মানবতাবিরোধী হত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আমি আবারও বলছি, এই সরকারের মূল কাজ যারা গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়েছে তাদের বিচার সবার করা।
আমরা সংস্কার, নির্বাচন অবশ্যই চাই তবে তার আগে আমাদের চাওয়া শহীদ পরিবার যেন তাদের স্বজন হত্যার বিচার নির্বাচনের আগেই পান। আমরা চাই নির্বাচনের আগেই গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা হোক। শহীদ পরিবারের চাওয়ার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত।