
ছবি: সংগৃহীত
পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. রুকনুল ফেরদৌস তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একদিন’ নামে একটি লেখা শেয়ার করেছেন। এই লেখায় ফুটে উঠেছে পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একগুঁয়ে স্বভাবের একটি চিত্র। স্ট্যাটাসটি শেয়ার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
রুকনুল ফেরদৌস লিখেছেন, এক সময় আমি কাজ করতাম ডঃ মমিনুল হক সরকার স্যারের সাথে। ডঃ মমিনুল হক সরকার স্যার হলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একজন নদী বিশেষজ্ঞ। তাঁর মাথাটা একটা আস্ত কম্পিউটার। আমাদের যে কাজটা করতে অনেক সময় লাগত, সেটা তিনি চোখের নিমিষে বলে দিতে পারতেন শুধু মাত্র স্যাটেলাইট ইমেজের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে। স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগ পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার। সেই হিসেবে আমি অনেক ভাগ্যবান।
অনেক বছর আগের কথা। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের নদী নিয়ে একটা প্রোজেক্টর সূচনা করেছিলেন। প্রোজেক্টের নাম ছিল “ক্যাপিটাল ড্রেজিং”। এটার জন্য একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও ছিল। তো “ক্যাপিটাল ড্রেজিং” প্রোজেক্ট শুরুর আগে দুইটা পাইলট প্রোজেক্ট নেওয়া হল যমুনা নদীতে। একটা সিরাজগঞ্জ এবং আরেকটা কুড়িগ্রাম জেলাতে। ঐ উচ্চ পর্যায়ের কমিটি, ডঃ মমিনুল হক সরকার স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছিল সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে (একটা নির্দিষ্ট জায়গায়) ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে কি না তা গবেষণা করে রিপোর্ট আকারে জানানোর জন্য। ঐ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অনেক কিছুর ভবিষ্যৎ ঠিক হবে।
আমাদের গবেষণার ফলাফল ছিল “যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না”।
পরিকল্পনা মন্ত্রীর বাসায় ডঃ মমিনুল হক সরকার স্যার গিয়েছিলেন এবং মন্ত্রী মহোদয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, “যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না”। কিন্তু “ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে” এই রিপোর্ট তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে গেছে। এখন উপায় কি? মন্ত্রী মহোদয় সরকার স্যার কে বললেন, আপনারা আবার নতুন করে রিপোর্ট ও প্রেজেন্টেশান তৈরি করুন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং এর দিন ১০/১২ কপি নতুন রিপোর্টটা নিয়ে আসবেন।
যেহেতু একটা রিপোর্ট চলে গেছে তাই এটা আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা অবগত করব। মিটিং এর দিন রিপোর্টটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিবেন। আমি মিটিং এর দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমতি নিয়ে আপনাকে রিপোর্টটা দিতে বলব। আশা করি প্রধানমন্ত্রী মানা করবেন না।
মিটিং শুরুর পর, প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলেন এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী আমাকে হাতের ইশারায় রিপোর্ট দিতে বললেন। আমি আমার সামনের রাখা রিপোর্টগুলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এর দিকে এগিয়ে গেলাম। তার ডান পাশে দাড়িয়ে সালাম দিয়ে এক কপি তার হাতে দিলাম। উনি হাতে নিয়ে এক এক করে রিপোর্টের পাতা উল্টাতে লাগলেন এবং পুরা রিপোর্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন।
ঐ সময় সবাই চুপ করে ছিল। যেন পিন পতন নীরবতা। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট টা তার টেবিল এ রেখে আমাকে বসতে বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাকি রিপোর্টগুলো অন্য মন্ত্রীদের দিব কি না? উনি অনুমতি দিলেন এবং আমি বাকি রিপোর্ট গুলো মন্ত্রীদের বিতরণ করে, আমার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম।
প্রধানমন্ত্রী অনেক কথা বললেন এবং শেষে বললেন, “ড্রেজিং হবে এবং এটাই আমার সাফ কথা। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। “আমি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আমি প্রধানমন্ত্রী কে খুব ভাল মানুষ এবং একজন দেশপ্রেমী জানতাম। আমার অনেক দিনের ধারণা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙ্গে শেষ হয়ে গেল। যে মানুষ একটা গরীব দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার কাছে হাজার কোটি টাকা নষ্ট হবে, এটা কোন ব্যাপার না। এটা কোন কথা হল? মনে অনেক প্রশ্ন আর হতাশা নিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম। আর কোন কথা বলি নাই।
মিটিং শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যাবার পর এক এক করে যখন সবাই চলে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব আমার কাছে এসে বললেন বাইরে গিয়ে যাতে আমি উনার জন্য অপেক্ষা করি। কথা বলবেন। বাইরে এসে আমি পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন উনি বের হয়ে আসলেন এবং আমাকে বললেন উনার গাড়িতে বসতে। সচিব এর গাড়িতে তার পাশে বসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হলাম। আর তখনই শুরু হল আমার উপর আক্রমণ। এমন কোন খারাপ গালি নাই যে সচিব আমাকে দেয় নাই। খারাপ ভাষায় অজস্র গালিগালাজ করছিলেন।
একবার জিজ্ঞেস করলেন, এই যে রিপোর্ট পরিবর্তন করলাম, তা তাকে জানালাম না কেন? বললাম, সত্যিটা প্রধানমন্ত্রীর জানা উচিত, তাই রিপোর্ট পরিবর্তন করেছি। এ কথা শোনার পর সচিব তার ড্রাইভার কে বললেন, গাড়ি থামাতে। মাঝ রাস্তায়, বিজয় সরণির কাছে গাড়ি থামলে, সচিব আমাকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়েছিল। হাটতে হাটতে ফার্মগেট চলে গেলাম। একটা সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে অফিসে ফেরত আসলাম। সব ঘটনা ডঃ মমিনুল হক সরকার স্যার এবং নির্বাহী পরিচালক স্যার কে বললাম। দুই জনই একই পরামর্শ দিলেন। এই ঘটনা এইখানেই শেষ। আমি যেন কাউকে না বলি।
পরবর্তীতে যমুনা নদীতে ঐ জায়গায় ড্রেজিং হয়েছিল এবং ড্রেজিং করে কোন লাভ হয় নাই।
রিফাত