
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গতকাল ফেসবুকে এক পোস্টে বসন্ত নিয়ে লিখতে গিয়ে তার শৈশবের কিছু অমূল্য স্মৃতিচারণ করেছেন।
শফিকুল আলমের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বেইলি রোড, হেয়ার রোড, এবং মিন্টো রোডের প্যাভমেন্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে। নব্বইয়ের দশকে বেইলি রোড ছিল খাবারপ্রেমীদের স্বর্গ, কিন্তু তার এক দশক আগে এই এলাকায় তিনি ছিলেন এক ভবঘুরে, সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়িয়ে নিতে কিংবা পুরনো ব্রিটিশ আমলের গাছ থেকে তেঁতুল আর কাঁচা আম পাড়তে।
তিনি লিখেন,“আমি ছিলাম ‘চারা’ খেলার পাগল, আর এই খেলায় সিগারেটের প্যাকেট ছিল এক অমূল্য সম্পদ। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন আমি এসব মন্ত্রী-সচিবদের অভিজাত পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম, বিরল কিছু সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাওয়ার আশায়-ডানহিল বা কে-টু-এর মতো। যত দুষ্প্রাপ্য একটি প্যাকেট, তত দামি তার মূল্য ‘চারা’ খেলায়! তারপর সেগুলো গর্বের সঙ্গে আমার মতিঝিল এজিবি কলোনির বন্ধুদের দেখাতাম।”
শফিকুল আলমের শৈশবের দিনের রুটিন ছিল নানা রকমের আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে।তিনি জানাান,“আমার মা-বাবা প্রায় কখনোই বুঝতে পারতেন না, স্কুল শেষে আমি আসলে কী করতাম। তারা জানতেন আমি হয়তো ফুটবল, ক্রিকেট বা গুলতি খেলে সময় কাটাচ্ছি মতিঝিলের খেলার মাঠে। কিন্তু আশির দশকের শুরুর দিকে আমার প্রতিদিনের রুটিনের একটা বড় অংশ ছিল ঢাকার রাস্তায় ঘোরাঘুরি। একদিন যেতাম রমনা পার্কে তেঁতুল পাড়তে, পরদিন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে ইঞ্জিন বদলানোর সময় ট্রেন দেখতাম। কখনো-বা গুলিস্তানে গিয়ে ম্যাজিকওয়ালাদের কৌশল আর ওষুধ বিক্রির নাটক উপভোগ করতাম “
তখন ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক ছিল প্রবল! অনেক বাবা-মা আসরের আজানের আগে সন্তানদের বাইরে যেতে দিতেন না। কিন্তু আমরা ছিলাম আট ভাই-বোনের সংসার! মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া খুব একটা কঠিন ছিল না। একদিন আমি এক মন্ত্রীর বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লাম, ইচ্ছে ছিল কোনো সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে নেওয়ার। দুজন পুলিশ আমাকে থামিয়ে কারণ জানতে চাইল। কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। তারা আমাকে অপমান করল, রমনা থানায় পাঠানোর ভয় দেখাল। বহুদিন সেই ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম।
বেইলি, মিন্টো, এবং হেয়ার রোডের পুরনো পরিবেশ এবং পাখিদের শোরগোলের কথাও তিনি স্মরণ করে লিখেন,“ সেই সময় বেইলি, মিন্টো, হেয়ার রোড ছিল শান্ত আর নিরিবিলি। রাস্তার ধারে নানা রকমের পাখি দেখা যেত। চিল ছিল কম, কিন্তু তোতা, ঘুঘু, কোকিল আর দোয়েল ছিল প্রচুর। তখন কাঁচা আম পাড়তে গিয়ে পাখির বাসা দেখতাম, কখনো বাচ্চা পাখিদের উঁকি মারতেও দেখেছি! কেউ এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। মন্ত্রীদের বাড়ির সামনেও আজকের মতো ভিড় থাকত না। একদিন দেখেছিলাম অভিনেত্রী ববিতাসহ কয়েকজন নামকরা তারকা এক মন্ত্রীর বাড়ির দিকে হাঁটছেন! পরে বন্ধুদের বলতেই সবাই ঈর্ষায় জ্বলছিল!”
আজকের বেইলি রোডে পরিবর্তন এসেছে,পুরনো সময়কে মিস করে তিনি লিখেন,“আজ বেইলি রোড একদম বদলে গেছে! পুরনো রেইন ট্রি গুলো কেটে ফেলে মন্ত্রীর নতুন ভবন বানানো হয়েছে। দিনভর লোকজনের আনাগোনা লেগে থাকে। সকালে রাস্তার অনেকটা জুড়ে বসে যায় এক ক্ষুদ্র বাজার, যেখানে হাঁটতে আসা ডায়াবেটিস রোগীরাও মাছ-সবজি কিনে নিয়ে যান! সকাল দশটার মধ্যেই বাজার গুটিয়ে যায়, তারপর পথঘাট দখল করে নেয় তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। বিকেলের দিকে মধ্যবয়সীরা এসে ভিড় জমায়, দীর্ঘায়ুর আশায় হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে চলে যায়!
তবে কোকিলের ডাক এখনো শোনা যায়! প্রতিদিন ভোরে তাদের কুহু কুহু ডাকেই ঘুম ভাঙে,জানিয়ে দেয়, বসন্ত এসেছে ঢাকা শহরে! উঠেই দেখি মন্ত্রীর বাসার ছাদে চিল বসে আছে, কিছুক্ষণ পর তারা আকাশে ভেসে বেড়াবে, কেমন কর্কশ আওয়াজ তুলবে। কিন্তু আমি যা সবচেয়ে বেশি মিস করি, তা হলো কাক! কোথায় গেল তারা? মনে হয়, ঢাকা আর কাকের শহর নেই! আকাশটা চিলের দখলে চলে গেছে!”
আফরোজা