ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

‘দুর্নীতি’ থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়া, বাংলাদেশের কোনো গতি নাই

প্রকাশিত: ০৩:২১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০৪:০৬, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

‘দুর্নীতি’ থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়া, বাংলাদেশের কোনো গতি নাই

ছবি : সংগৃহীত

দুর্নীতি থেকে বের হয়ে সরকার চালানোর প্রতিজ্ঞা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যাতে কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করতে না পারে, সেভাবে সরকার ও সমাজ চালাতে হবে।

তিনি বলেন, “দুর্নীতি সব শেষ করে দিচ্ছে। এটা থেকে বের হতে না পারলে, বাংলাদেশের কোনো গতি নাই।'”

রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনের নৈশভোজে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ডিসি সম্মেলনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। এদিন সকালে তিন দিনের ডিসি সম্মেলন শুরু হয়।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা পৃথিবীর অষ্টম জনসংখ্যার দেশ। কাছেই সোজা কথা না, তলার জায়গা না, একদম উপরের জায়গা। মানুষ এগোতে পারছে না বহু দেশে, তার মানুষের অভাবে। আমরা যে মধ্যপ্রাচ্যে লোক পাঠাই, তারা কোন দুঃখে আমাদেরকে নেয়। তাদের লোক নাই, টাকা আছে, লোক নাই। সেজন্য আমাদেরকে ডাকে। পৃথিবীর সব লোক বসে আছে, কখন আমাদের থেকে লোক পাবে।

আমি প্রায় বলেছি, চীন যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, চীন হলো সবচাইতে বেশি, সর্বোচ্চ সংখ্যক জনসংখ্যার দেশ, যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, কিছুদিন পরে বোধহয়, আমাদের কাছ থেকে লোক চাইবে। তারা এত টান করবেন। এই হলো আমাদের সুযোগ। আমাদের সুযোগ শুধু সংখ্যায় না, আমি সংখ্যার উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না, সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রতিটি তরুণ, বাংলাদেশের মহাশক্তি, মহাপ্রচন্ড শক্তি।

সেই তারুণ্য বিশ্বজয় করতে পারে, সেই তারুণ্য। সেই তারুণ্য, আমাদের যত রকমের অভাব আছে, যত রকমের ঘাটতি আছে, তার চাইতে অনেক বেশি, সে নিয়ে আসতে পারে। যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজন্ম, সেই প্রজন্মের জন্য দরজা খুলে দিতে হবে। আমরা শুধু বসে আছি, দরজা তালা লাগানোর জন্য। এটা বলতে পারি, এটা অনাবশ্যক।

তিনি বলেন, আমরা সবাই অনুভব করি, আমাদের তারুণ্য জুলাই মাসে যা দেখিয়েছে, আগস্ট মাসে যা দেখিয়েছে, সেটা তো পৃথিবীর একটা অনন্য দৃষ্টান্ত। এটা সাধারণ একটা ঘটনা না, যেরকম করে অন্য দেশে বিপ্লব হয়, এই হয়। এই বিপ্লব কোথাও হয় নাই। তার প্রতিটি জিনিস যদি আপনারা বিচারে বসেন, দেখবেন যে এটা প্রতিটি দিক থেকে অনন্য। সেই অনন্য ক্ষমতা এদেশের তরুণদের মধ্যে আছে, এটা হারিয়ে যাবে না। আপনারা মনে করেন না যে, এটা এক ঘটনায় শেষ, শেষ হয় নাই, শুরু হলো মাত্র।

কাজেই সেইভাবে আমাদেরকে এই তরুণদের সুযোগ দিতে হবে। ডাক্তাররা আমাদের কাছে আক্ষেপ করে, হাসপাতালে আক্ষেপ করে, যখন আমরা বলি, আপনারা কেরালা থেকে কেন নার্স আনেন, বলে দেশে নার্স নাই। ডাক্তাররা আমাদেরকে এমন কথা বলে, আমাদের এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, এখানে প্রতিজন নার্সের বিপরীতে আমাদের তিনজন ডাক্তার আছে। রেশিও হলো ১:৩। একজন নার্স, তিনজন ডাক্তার। পৃথিবীর মানুষ হা হয়ে যায়, কথা শুনে। এখানে হওয়ার অর্থ ছিল উল্টাটা। একজন ডাক্তারের পেছনে তিনজন নার্স, অন্তত।

তিনি আরো বলেন, নার্স চালায় সবকিছু, ডাক্তার সিদ্ধান্ত দেখে। এখন সেই সিদ্ধান্ত কাকে দেবে, আপনার যদি নার্স না থাকে। বলে তো না, আমাদের তো নার্স নার্সিং কলেজ আছে। আপনি ঘুরে দেখুন। সেটার কোয়ালিটি, কাজেই এইটা দিয়ে আমাদের কোন কাজ হচ্ছে না। তো দুঃখ পেয়ে মনে করলাম যে, আমরা নিজেরা একটা ছোট্ট নার্সিং কলেজ করি না কেন! করলাম।

‘গ্লাসগো ক্যালিডোনিয়ান ইউনিভার্সিটি’র সহায়তায়, যেহেতু সেই ইউনিভার্সিটিতে আমি চ্যান্সেলর, কাজেই আমার কথা সে ফেলে দিতে পারছে না, যে আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি একটা নার্সিং কলেজ করবো বাংলাদেশে। পুরোপুরি সাহায্য করলাম এবং চমৎকার একটা নার্সিং কলেজ তৈরি হলো। মাত্র ৪০ জন মেয়ে নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। গ্রামীণ ব্যাংকের মেয়ে, পরিবারের মেয়ে, যাদের গরীব ঘরের মেয়ে।

আমরা নার্সই যখন বানাবো, অন্যদের দেবো কেন, গরীব ঘরের মেয়েদের দেবো, সে ইংরেজির একটা অক্ষর সে বলতে পারে না। কোন রকমের লেখাপড়া শিখেছে, আমরা তাকে দিলাম। নার্সিং ডিগ্রি পাওয়ার আগেই তার টুকুর ইংরেজি আন্তর্জাতিক মজলিসে এসে বক্তৃতা করে। তার ভবিষ্যৎ কি রাখে সেগুলো নিয়ে কথা বলে। আজকে সে নার্সিং কলেজে বড় কলেজে পরিণত হয়েছে। 

আমার বিষয়টা হলো, বড় কলেজ হওয়ার বিষয় না, হঠাৎ দেখি নানা দেশ থেকে লোকজন আসে, বিশেষ করে প্রথম যেটা ধাক্কা লাগলো, সেটা হলো, ইউকে থেকে যুক্তরাজ্য থেকে ডেলিগেশন আসলো, রিক্রুটার আসলো, বলল যে আপনাদের এই নার্সিং কলেজে যত ছাত্রী পাশ করে, গ্রাজুয়েশনে যত থাকে, আমরা সবাইকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাব, আপনাদেরকে অফার দিলাম। আপনারা কি কি চান, সব আমাদেরকে বলেন। আমরা সেটা পরিপূর্ণ করব।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমরা তো যুক্তরাজ্যে পাঠানোর জন্য নার্স বানাচ্ছি না এখানে। তবু বুঝতে চেষ্টা করে বলি, আমাদের নার্সের ভীষণ অভাব। যেখান থেকে আবার আমাদের উপর হুকুম হয়েছে, নার্স জোগাড় করতে হবে এবং আমাদের তালিকায়, আপনাদের নামও আছে। আমরা আপনাদের কাছে এসছি। আপনাদের এন্টায়ার ক্লাস, আমাদের আর কোন পরীক্ষা দিতে হবে না, কিচ্ছু দিতে হবে না, শুধু আপনারা সার্টিফিকেট দিবেন। আমরা নিয়ে যাব। আমি তাদের কাছে বিনয়ের সুরে বললাম যে, এটা আমাদের দেশের জন্য করেছি। আমরা তো দিয়ে দেবো না এদেরকে। এদেরকে দেশের কাজ করার জন্য দেব।

তবে আমাদের শুধু নিজেদের পরীক্ষা করার জন্য, দুইজন কি তিনজন দেব, যাদের আমরা দেখি, ওরা কিরকম কাজ করে। আপনাদের পাল্লায় এরা উঁচু স্তরে, না নিচু স্তরে, কোন স্তরে। বলে না, সেটা পরীক্ষা করতে হবে না, সে পরীক্ষা আমরা ইতিমধ্যে করে ফেলেছি। যা যা আমাদের দরকার। আপনারা যত চান, দিতে পারেন।

আমি সবিনয়ে নিয়ে বললাম যে, দুইজন তিনজনের বেশি আমরা দেবো না এখন, ভবিষ্যতে যদি আমাদের সামর্থ্য হয় তো। এটাতে খুব আনন্দ উপভোগ করলাম যে, আমরা যেটা বাংলাদেশের জন্য করছি, সেটা ইউকেতেও, তার ডিমান্ড আছে, চাহিদা আছে। আমরা দরখাস্ত নিয়ে ঘুরছি না, তারা আমাদের কাছে আসছে।

কিছুদিন পরে দেখি জাপান থেকে আরেকটা ডেলিগেশন। তারা আমাদের নার্স চায়। সবাইকে চায়। বলছে শুধু আমাদের একটা শর্ত, জাপানি ভাষাটা আমাদের, আমরা শিখিয়ে দেব তাদেরকে, এই সুযোগটা আমাদেরকে দিতে হবে। এবং খুব সিম্পল জাপানি ভাষা, কোন কঠিন জিনিস না, তারা লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা শিখে যাবে। আমরা সেই ব্যবস্থা আমাদের হাতে। একই জবাব দিলাম, ধন্যবাদ দিলাম।

আমি সবিস্তারে এটা বললাম এজন্য, আমরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় করি বাংলাদেশে। কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ফেলছি আমরা। এত বিশ্ববিদ্যালয় যখন আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক, একটা করে নার্সিং কলেজ যোগ করে দেন। অন্তত মেয়েগুলা, ছেলেগুলা যারা শিখবে, দেশেরও কাজে লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, এই চাহিদা কোনদিন মেটাতে পারবে না কেউ। আমরা যত নার্স বানাতে পারি, অফুরন্ত চাহিদা। তাও চিন্তাটা কিসের আমাদের! আমাদের চিন্তার দোষ, কপালের দোষটা, না হলে আমরা পারছি না কেন। কারণ আমাদের তো আদর করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। 

তারপরে দেখলাম আরেক চাহিদা, এই আমাদের এই ছোট্ট জায়গাতে, ছোট কাজের মধ্যে, কেয়ার গিভার। আপনারা সবাই জানেন, কিচ্ছু না, ছয় মাসের ট্রেনিং। ছয় মাসের ট্রেনিং দিলে, জাপান হাজারে হাজারে নিয়ে যাবে, ইউরোপ হাজারে হাজারে নিয়ে যাবে। শুধু ছয় মাসের ট্রেনিং, আমরা পারছি না কেন!

আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আমরা এক জিনিস বানিয়েছি, যেটা যখন বসি, সবাই দুঃখে ভরে যায়। কিভাবে সিস্টেমটা চলছে বা চলছে না। আপনারাও দুঃখ করেন, আমরাও দুঃখ করি। কাঠামোগতভাবে এমন এক জিনিস এটা, বুঝতে পারি না, এটার থেকে উদ্ধারের উপায় কি।

কাজেই আমাদের জগতটা, আমাদের সামনে বিশাল জগত, শুধু আমাদের সিদ্ধান্ত এবং আমাদের কর্মসূচি গুলো ঠিক করার অপেক্ষায়। এই যে এত বড় সুযোগ আমাদের আছে এবং এগুলো বাস্তবায়ন হবে, এটা নিয়ে আমার চিন্তা নাই। এই তারুণ্য আমাদের আছে। এই মেয়েরাও আছে আমাদের। এই প্রাকৃতিক সুযোগ গুলো আমাদের আছে। আমাদের সবচাইতে বড় সমস্যা, দুর্নীতি সব শেষ করে দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটা কথা শুধু বললাম, একটা উদাহরণ। এই উদাহরণ সর্বত্র। যেকোনো পরীক্ষায় আপনারা দেখবেন, বাংলাদেশ দুর্নীতির তালিকায় সর্বনিম্ন। সততা বলে আমাদের আর কোন জিনিস নাই। শৃঙ্খলা বলতে আমাদের আর কোন জিনিস নাই। কাজেই এই দুর্নীতি থেকে বাইর না হলে, এই কোনটাই হবে না। আমরা আজকে এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস এর সমিতির সম্মেলনে এসেছি, কাজেই এই দুর্নীতি কোথায় আছে, কিভাবে আছে, তাদের অজানা নয় এবং এটা ছাড়া, এটার থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়া, বাংলাদেশের কোন গতি নাই।

এটা থেকে বের হতেই হবে, আমাদের আর সব কথা আপনি বাদ রেখে দেন, আমরা সব বুঝি, এটার থেকে বের হতেই হবে, এটার থেকে আমরা কেউ মুক্ত হতে পারছি না। এমন গভীরে ঢুকে গেছে এটা এবং আমরা যত বক্তৃতাই করি, এটা অসার বক্তৃতা, যদি না ওই স্কেলে আমরা একটা সৎ জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি।

মো. মহিউদ্দিন

×