
প্রতুল মুখোপাধ্যায়
‘আমি বাংলায় গান গাই’, ডিঙ্গা ভাসাও’, ‘আলু বেচো’, ‘ছোকরা চাঁদ’, ‘তোমার কি কোনো তুলনা হয়’, ‘সেই মেয়েটি’, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’-এর মতো অসংখ্য বাংলা গানে শ্রোতার মন জয় করেছেন বারবার। বাংলা ও বাঙালির আত্মা যেন তার গানে জলছাপের মতোই থেকে গিয়েছে। নিজের গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার কখনোই পছন্দ করেননি।
কিন্তু গাওয়ার সময় তার কণ্ঠনিঃসৃত জাদুতে গানের কথার সুরেলা চলন মগ্ন করে রাখে শ্রোতাকে। তিনি হলেন বাংলা গানের ব্যতিক্রমী সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটে চলা বন্ধ হলো তার। থেমে গেল ‘বাংলায় গান, বাঙালির গান গাওয়া। দীর্ঘ রোগভোগের পর শনিবার ভোরে তার গানের পঙ্ক্তি মেনেই যেন অচেনা সাগরে ডিঙ্গা ভাসালেন।
শনিবার সকালে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। অন্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রবীণ এই শিল্পী। গত সোমবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। শনিবার সকালে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা সংগীত অঙ্গন। শিল্পীর প্রয়াণের খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটে যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্রসদনে। দুপুর থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মরদেহ রাখা হয় সাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ যেহেতু দান করা হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে, তাই সেখানেই আবার ফিরিয়ে আনা হয়।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোক জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, আধুনিক বাংলা গানের খ্যাতনামা শিল্পী, গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আমি শোকাহত। যত দিন বাংলা গান থাকবে তত দিন ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বাঙালির মুখে মুখে ফিরবে।
অবিভক্ত বাংলার বরিশালে ১৯৪২ সালের ২৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বাবা প্রভাত চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। মায়ের নাম বাণী মুখোপাধ্যায়। দেশভাগের পরে তারা প্রতুলকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। থাকতে শুরু করেন চুঁচুড়ায়।
১৯৫২ সালে তার স্কুলে যাওয়া শুরু। স্কুলের মঞ্চেই অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তিনি। গায়ক অভিনেতা হিসেবে একটি স্কুলের নাটকের মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ছোট থেকেই গান লিখে তাতে সুর দিয়ে গাওয়ার ঝোঁক ছিল তার। কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় সুর দিয়ে শুরু। নিজেও লিখতেন।
১৯৬২ সালে তিনি প্রথম গান লেখেন। এর আগে বিভিন্ন কবির কবিতায় সুর দিতেন তিনি। তারপর এক দশক ধরে বেশ কয়েকটি গণসংগীত রচনা করেন।
অথচ প্রথাগত কোনো সংগীত শিক্ষা তিনি নেননি। নিজের হৃদয় নিঃসৃত আবেগকেই সুর ও কথার মেলবন্ধনে বেঁধে ফেলতে শিখেছিলেন। আমৃত্যু প্রতুল নিজের হৃদয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন গানের প্রদীপ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও চিকিৎসকদের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শোনাতেন। সারা জীবন ধরে অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গিয়েছেন। বাংলা আধুনিক গান থেকে জাপানি গান, আবার হিন্দি ছবির গান থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেছেন। সৃষ্টি করেছেন একের পর এক গান।
এক সময়ের নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড লং রেঞ্জ প্ল্যানিং বিভাগের সাবেক প্রধান ব্যবস্থাপক প্রতুল গানকেই করেছেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। নকশালদের মধ্যে তিনি পরিচিত ছিলেন সেজদা কমরেড নামে।
জীবনের প্রথম অ্যালবাম ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ (১৯৮৮)। তবে সেটি একক অ্যালবাম নয়। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়েছিল। এরপর ১৯৯৪ সালে ‘যেতে হবে’ প্রতুলের প্রথম একক অ্যালবাম। শেষ অ্যালবাম ‘ভোর’ (২০২২)। সেখানে সঙ্কলিত হয়েছিল শিল্পীর অপ্রকাশিত গানগুলো।
তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়াও ‘আলু বেচো’, ‘ডিঙ্গা ভাসাও’, ‘ছোকরা চাঁদ’, ‘তোমার কি কোনো তুলনা হয়’, ‘সেই মেয়েটি’, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’ প্রভৃতি। প্রতুলের জীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’ এই গান। বাংলা ও বাঙালির আত্মা যেন ওই গানে জলছাপের মতোই থেকে গিয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রতুলের একটি অ্যালবাম প্রকাশ হয় ২০১১ সাালের মার্চে। অ্যালবামটির নাম ‘আমি বাংলায় গান গাই’। এই গানেই প্রতুল বেশি মিশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের দর্শক-শ্রোতার মাঝে। ‘গোঁসাই বাগানের ভূত’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।