ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

বসন্তের হাওয়ায় ভালোবাসার উদযাপন

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০০:০৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বসন্তের হাওয়ায় ভালোবাসার উদযাপন

ছুটির দিন শুক্রবার ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছে তরুণ-তরুণীরা

দিনটাই ছিল সুন্দরের। প্রাণের শহরে ভর করেছিল অদ্ভুত এক লাবণ্য। নগর সভ্যতায় বনানী হারিয়ে গেলেও ধুলোমাখা কিছু পথ ঢেকে গেল শিমুল, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচূড়া ফুলে। যান্ত্রিক শহরেও শোনা গেছে কোকিলের কুহুতাল। এভাবে বহু বর্ণের আবির মেখে হাজির হলো ফাগুন। নগরজুড়ে বয়ে গেল রংয়ের প্লাবন। নাগরিকের শরীর থেকে মনের সবটুকু জুড়েছিল রঙিলা আস্তরণ।

প্রকৃতির সজীবতা ফিরে পাওয়ার দিনে শহরবাসীর মনে প্রাণে বয়ে গেছে শিহরণ। রমনার ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি জানান  দিয়েছে ঋতুচক্রে ঘটেছে পরিবর্তন। কংক্রিটের বৃত্তবন্দি ঢাকা ঝলমল করেছে ঋতুরাজের আগমনী বারতায়। শহীদ মিনারের ঊর্ধ্বগগনে উঁকি দেওয়া রক্তিম পলাশ বলেছে- আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে ...। কবির কথা ধার করে কেউবা বলেছে- নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়/বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?

দখিনা সমীর তার গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল? আর বসন্তের সেই  উতলা হাওয়ায় চেপে যেন হাজির হয়েছিল ভালোবাসার দিনটি। এভাবেই বসন্তের রং মেখে উদ্যাপিত ভালোবাসা দিবস। সেই সুবাদে প্রেমিকযুগল বলে উঠেছে ঝড়-বৃষ্টি পেরিয়ে দুর্ঘটনা এড়িয়ে তোমার কাছে আসা/চাওয়া শুধু একটাই, একটু ভালোবাসা ...।  এদিন ছিল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ইতিহাসের পাতায় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে। সেই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার একইসঙ্গে উদযাপিত হয়েছে ভালোবাসা ও বসন্ত দিবস। 
এদিন দখিনা বাতাসের সেই আকুলতায় চারুকলার বুকলতলার প্রভাতী আয়োজনে রূপে-রঙে ধরা দিয়েছে বসন্ত। শুধু কি তাই, শহীদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল বইমেলা প্রান্তরকে ছুঁয়ে গেছে সেই বাসন্তীরঙা বসন্ত। নগরের  নানা প্রান্তে হয়েছে বসন্ত বরণের আয়োজন। ফাগুন হাওয়ায় অনুষ্ঠান আর আয়োজনে চঞ্চল হয়েছে সংস্কৃতিপ্রেমী নাগরিকের উতলা মন।

দখিনা হাওয়া মেখে শহরে এ প্রান্ত সে প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরবাসী। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে নর-নারী, শিশু থেকে শুরু করে তরুণ, কিশোর, যুবা, মধ্যবয়সী কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ। শূন্যে উড়েছে লাল, সবুজসহ রকমারি রঙের আবির।সম্প্রীতির বন্ধনে একে অপরের গাল রাঙিয়েছে বর্ণবহুল আবিরের ছোঁয়ায়। কোমলহাতের কব্জিগুলো ছুঁয়েছে ফুলে ফুলে গাঁথা রাখীবন্ধনী।

বসনে উঠেছিল বাসন্তী কিংবা হলদে শাড়ি। তরুণীর খোঁপায় শোভা পেয়েছে পুষ্পমালা। কারও বা কপালে চেপে বসেছিল গোলাপ, গাঁদায় গড়া টায়রা। পুরুষের পাঞ্জাবি বা ফতুয়ায় দেখা মিলেছে বাসন্তীসহ নানা রঙের ছড়াছড়ি। এভাবেই বহু বর্ণে ঋতুরাজ বলেছে, এই শহরজুড়ে আজ এসেছে বসন্ত। 
প্রকৃতি নিয়ম মেনে শীতের কাতরতা ছাপিয়ে উষ্ণতার সঙ্গে নিসর্গের নান্দনিকতা নিয়ে এলো ঋতুরাজ বসন্ত। সুন্দরের বারতায় গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, বক্তার কথায় কিংবা নৃত্যের মুদ্রায় ছিল তার অনন্য প্রকাশ। মনের অলিন্দে উত্তাপ ছড়ানো বসন্তের প্রথমদিন পহেলা ফাল্গুন।

প্রকৃতির পালাবদলে নাগরিক মনে যেন অজান্তেই গুঞ্জরিত হয়েছে ‘ওরে ভাই ফাগুন এসেছে বনে বনে’। শুধু বনে নয়, মানুষের মনেও লেগেছিল ফাগুনের ছোঁয়া। কবি নির্মলেন্দু গুনের কথামতো এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে, মনের ভেতরজুড়ে আরও এ মনের মর্মর ...। রূপময় এই ঋতু বরণে নিজের সুবিধামতো সময়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে রাজধানীবাসী।

পোশাক ও মননে ছিল বসন্ত বরণের নয়নজুড়ানো দৃশ্য। মন আর প্রাণের মমতায় উচ্চারিত হয়েছে বসন্তের জয়গান। নগরের নানা প্রান্তে ছিল বসন্ত বন্দনার বহুমাত্রিক আয়োজন। সেসব আয়োজনে শামিল হয়ে প্রকৃতির পালাবদলে প্রাণ প্রাচুর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে শহরবাসী। মাতোয়ারা হয়েছে বসন্ত উদ্্যাপনের অনাবিল আনন্দে। এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বসন্তের হাওয়া মেলে প্রেমিকযুগল নাবিল ও শায়লা।

কথা প্রসঙ্গে এই জুটি জনকণ্ঠকে বলেন, দখিনা বাতাস আর কৃষ্ণচূড়া-পলাশে রংমাখা এমন দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায়? প্রকৃতির রংগুলো যে কড়া নেড়ে আমাদের প্রেমকাননে। প্রকৃতিকেন্দ্রিক এমন উৎসবমুখরতায় প্রেমটা যেন আরও বেশি জমে ওঠে। তাই অন্যদিনের চেয়ে এদিনেও ভালোবাসার রংটাকেও বেশি গাঢ় মনে হয়। তাদের কথাগুলে যেন মনে করিয়ে দেয় কবিতার সেই চরণখানি- আমার চোখে বসন্ত দারুণ চৈত্রমাস চতুর্দিকে শিমুল-পলাশ কৃষ্ণচূড়ার ত্রাস।  


ফাগুনের প্রথমদিন বসন্ত বরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকাজুড়েই উদযাপনের মাত্রাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজনটি বসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়।  প্রতিবছরের মতো  এবারও সকালে  সবুজ শ্যামল এই আঙিনায়  বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেন জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ।

চারুকলার বাইরেও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩নং সেক্টরে উন্মুক্ত বসন্ত বন্দনার আয়োজন করে পরিষৎ। থেমে থাকেনি বসন্ত বন্দনা। চারুকলা এবং বাহাদুর শাহ পার্কে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উদ্যাপিত হয়েছে বসন্ত উৎসব। নাচ-গান ও কবিতায় মুখরিত ছিল এই দুই মঞ্চের আয়োজন। এসব মঞ্চের পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া দেশের অগ্রগণ্য নৃত্য ও সংগীতের দলসমূহ ছাড়া একক পরিবেশনা, শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবেশনার  সঙ্গে ছিল বসন্ত কথনপর্ব, প্রীতি বন্ধনী বিনিময় ও আবির বিনিময়। উৎসবে সাংস্কৃতিক আয়োজনের ফাঁকে ছিল আবির মাখানো পর্ব। সে রং যেন লেগেছে সকলের মরমে। লাল-নীল-হলুদ রঙের আবির ছুঁয়েছে গাল থেকে কপালে। একে অন্যের কপালে ও গালে ছুঁয়ে দেওয়া বর্ণবহুল আবিরের মাখামাখিতে  উৎসবটি হয়ে ওঠে আরও রঙিন।

চারুকলা বসন্ত কথনপর্বে সভাপতিত্ব করেন পরিষতের রসভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমদ। বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ ও সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইটসহ  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ।
এদিকে বসন্তের দিনে ভালোবাসার আকুলতায়  তীব্র আকুলতায় ভেসেছেন অনেকেই। সেই নজির রেখে এদিন ভরদুপুরে পরস্পরের হাতটি ধরে হাঁটছিলেন দু’জনে।  রমনার সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে চলছিল তাদের ভাব-বিনিময়। কিছুক্ষণ পরপর পরস্পরের মধ্যে হচ্ছিল চোখাচোখি। সে চোখের ভাষায় ছিল একে অপরের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার আহ্বান। মুখে ছিল প্রণয়ের সংলাপ।

সুন্দরতম সেই টেনে নিয়ে যায় এই প্রেমিক-প্রেমিকার সম্মুখে। পরিচয়টি পেশ করে জানতে চাই তাদের প্রেমের কথা। সদ্য  প্রেমে পড়া এই জুটি পুরো নামটি না বলে জানিয়ে দেন ডাকনামটি। চঞ্চল ও পারমিতা নামের প্রেমিকযুগল বলে ওঠে, এই তো বছরখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আমাদের  পরিচয়। শুরুরদিকে সেই অন্তর্জালেই একটু একটু করে জেনেছি একে অপরকে।

এরপর মুঠোফোনের কথোপকথনে ধীরে ধীরে বেড়েছে পরস্পরের প্রতি ভালো লাগা। একপর্যায়ে যেন ভালো লাগা রূপান্তরিত হয়েছে ভালোবাসায়। আজ প্রেম নিবেদনের বিশেষদিনে মিলিত হলাম একান্তে। বলে ফেললাম ফোনে বলতে না পারা জমে থাকা মনের সবটুকু কথা। এখন দু’জন মিলে প্রেমের মাঝে জীবনের পূর্ণতা খোঁজার চেষ্টা করছি।

ভবিষ্যত জীবনসঙ্গীর ভালো লাগা ও মন্দলাগার বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করছি। ঘটছে আমাদের দু’টি  হৃদয়ের সবটুকু প্রকাশ। সবকিছু মিলে মনে হচ্ছেÑপ্রেম একটি শিল্প, একটি দর্শন এবং  বেঁচে থাকার প্রধান আকর্ষণ।      


এই প্রেমিকযুগলের কথামতোই ভালোবাসা ছাড়া পূর্ণতা পায় না মানবজীবন। অপরিপূর্ণ সেই জীবনটা হয়ে ওঠে বিবর্ণ। তাই  তো ভালোবাসার প্রাপ্তি বা পরিচর্যায় জীবন হয় সুন্দর ও স্বার্থক। সৃষ্টির অনাবিল আনন্দে সমান্তরাল পথে এগিয়ে চলে জীবন ও ভালোবাসা। পারস্পরিক মমতার বন্ধনে চিত্রিত হয় একে-অপরের অতি আপনজন হয়ে ওঠা ক্যানভাসটি।

সেই বন্ধন অটুট রাখার প্রচেষ্টায়  নীরার বাগান কবিতায় কবি বলে যায়- যতো না এঁটেল মাটি তার চেয়ে বেশি ছিল বালি/এই বালির ভেতরে ধীরে-ধীরে জীবনের ফুলকে ফোটানো/কাজটা সহজ ছিল না মোটেও তার জন্য শ্রম চাই, চাই নিষ্ঠা, চাই ভালোবাসা/চাই প্রয়োজনমতো জল-হাওয়া ...।

রাগ-অনুরাগে হৃদয়ের সেই নিভৃত অনুভবের সন্ধানে বিশ্বকবির উচ্চারণটি এমন- সখী, ভাবনা কাহারে বলে/সখী, যাতনা কাহারে বলে/তোমরা যে বল দিবস-রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা সখী, ভালোবাসা কারে কয়...। সুরের আশ্রয়ে এভাবেই মনের গহীনে আলোড়ন তোলা বিচিত্র এ অনুভবকে  উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন অনেকেই।

×